বাঙালির বিস্মৃত এক অন্যতম বীর ‘শামছুল হক’
Share on:
বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে অনিবার্যভাবে যাদের নাম এসে পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম শামছুল হক। যুগপৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, প্রগতিবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে এক দশকেরও বেশি সময় ঝোড়ো ঈগলের মতো গতিশীল ছিলেন শামছুল হক। আজ এ মহান নেতার ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
শামছুল হকের জন্ম মহান ভাষা আন্দোলনের মাস অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮ সালে; টাঙ্গাইলের বর্তমান দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিনে, তাঁর মাতুলালয়ে। তাঁর নিজ গ্রাম একই উপজেলার মাইঠাইন-টেউরিয়া। সাংগঠনিক ক্ষমতা আর বাগ্মিতার জন্য শামছুল হক স্কুলজীবনেই ব্যাপক জনপ্রিয় হন। করটিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর সুদৃষ্টি লাভ করেন। তিনি ছাত্র সংসদ গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা ভিপি পদ লাভ করেন।
১৯৩৬ সালে শামছুল হক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে, যেখানে বিখ্যাত ‘লাহোর প্রস্তাব’ পেশ হয়; অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৪৩ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ কর্মী শিবির স্থাপিত হলে তিনি দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন, যদিও তখন সবে ইতিহাসে অনার্স পাস করেছেন। যুগের চাহিদা অনুয়ায়ী তিনি তখন ‘বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে যোগ দিয়ে আশাহত হন। তখন লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেট বনাম স্টেটস’ বিতর্কে তিনি স্টেটের পক্ষে ছিলেন।
শামছুল হককে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ অর্গানাইজার পদে বসান। ১৯৪৯ সালে ইতিহাস বদলে দেওয়া টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত হন। সেই প্রেক্ষাপটে তিনি তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বিষদৃষ্টিতে পড়েন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কারাবরণ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সবাই জানেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হন নতুন এ দলের সভাপতি, শামছুল হক সাধারণ সম্পাদক। জেলখানায় বন্দি অবস্থায় ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার শর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব ছিল শামছুল হকের।
তবে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে কারাগারে শামছুল হককে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়। তাঁর স্ত্রী দুই কন্যাসহ নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ও তাঁর চোখের মণি কন্যাদ্বয়কে দেখতে না পেয়ে মানসিক রোগ দেখা দেয়। এ অজুহাতে তড়িঘড়ি করে লীগের দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দুঃখজনক হলো, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও শামছুল হকের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা হয়নি। ১৯৫৩ সাল থেকে অনাদর, অনাহার, নিজ দলের অবহেলা, মুসলিম লীগের তিরস্কার, নিজ বংশধরদের অসহযোগিতার মিলিত ফলে সৃষ্ট অভিমানে তিনি ১৯৬২ সালে নিখোঁজ হন। ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কালিহাতীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এক সময়কার কংগ্রেস নেতা মৌলভি মহিরুদ্দীনের বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ গঠনের পরপরই ১৯৪৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি ইডেন কলেজের অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। দুই কন্যার মধ্যে ড. শাহীনের জন্ম হয় ১৯৫১ সালের ৯ এপ্রিল এবং ড. শায়কার জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনে শামছুল হকের জেলবন্দি অবস্থায়, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে দুই মেয়ে আমেরিকার নাগরিক। ড. শায়কা নাসায় মহাকাশবিদ এবং ড. শাহীন আমেরিকায় কর্মরত।