মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৫, অগাস্ট ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর অসম্মানের পথ তৈরি করে দিল কারা?

Share on:

প্রায় ৫০ বছর হতে চলেছে, এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দুই কন্যাসন্তান ব্যতীত সপরিবারে কিছু ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।


ঘাতক দল ও তাদের সহযোগী এবং এই হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা শুধু তাঁকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; মানুষের মন থেকে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, কোনো কিছু থেকেই বিরত থাকেনি। মানুষের জীবনের প্রতিদিনের চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে তাঁর অস্তিত্ব বিলীন করার সব কৌশল অবলম্বন করে তারা। এদের দ্বারা দুই দশক ধরে ইতিহাস বিকৃতির চরম উদাহরণ প্রত্যক্ষ করে সাধারণ মানুষ।

সামাজিক সংস্কৃতি-শিক্ষা ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে কিন্তু অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রবেশ করানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধ্যান-ধারণা, যা স্পষ্টত প্রশ্রয় পেতে থাকে রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছ থেকে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো একটা নিকৃষ্ট ঘটনার প্রতি জনগণের যে কোনো রকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে এবং নিজেদের কৃতকর্মের দায় থেকে বাঁচাতে নৈতিক ও আইনগত প্রতিরক্ষা নিতে গিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ব্যতীত দেশ রক্ষা করা যেত না’– এ কথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নানান কুৎসা রটনার অপকৌশল নিল।

কোনো সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করার অনেক পরিস্থিতিই তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল তার ব্যতিক্রম ছিল, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু তাঁকে হেয় করতে গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর দীর্ঘদিনের অনন্য অবদান, তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন-সংগ্রাম, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বকে পর্যন্ত তারা অস্বীকার করতে শুরু করে। এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে তারা এ দেশের মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও মানুষের মনে ভুল ধারণা প্রোথিত করতে থাকে। প্রতিটি স্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করা লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে ‘দায়মুক্তি’ আইন করে হত্যাকাণ্ডের জন্য নিজেদের বিচারের আওতার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে।

পরে অবশ্য জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটে এবং দেশে নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা

প্রতিষ্ঠায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়। আমরা এই পরিবর্তনকে অভিহিত করলাম ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ বলে।

অনেক আশা-প্রত্যাশা, নিরাশা, হতাশার মধ্য দিয়ে প্রায় ৩৫ বছর কাটল জাতির। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত হবে– সেটাই সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তো কোনো একক ব্যক্তির চিন্তা বা শখ থেকে তৈরি হয়নি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা নির্মাণ করেছে। মানুষ সে জন্য প্রাণ দিয়েছে।

সেই আদর্শ ও চেতনাকে তুলে ধরা এবং আপামর জনসাধারণের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে পরিণত করার মূল কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে শেখ মুজিবুর রহমানের। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি অভিহিত হয়েছেন জাতির পিতা হিসেবে। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। একটি সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীনতার নীতিভিত্তিক দেশ অর্জনে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের আসন পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সব মানুষের হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন– ‘এ দেশের মানুষ মুক্তি চায়।’ তিনি আরও বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়, তেমনি চায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। অর্থাৎ এ দেশের সব রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে সমতা ও ন্যায়বিচারের নীতি প্রযোজ্য হবে যে কোনো পরিচয় নির্বিশেষে। কোনো পরিচয়েই রাষ্ট্র কারও প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব করবে না। দেশের সব নাগরিক– নারী, পুরুষ, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে, ধর্ম-বর্ণ– সে বিবেচনা ব্যতিরেকেই আইনের চোখে সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিদার হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধুকে সেই কাজ সমাধা করার সময় দেওয়া হয়নি। ঘটে গেল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। পরবর্তী সময়ে রাজনীতির নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হবে– জনমনে সেই প্রত্যাশা বাসা বাঁধে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কিছুটা পূরণও হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে দাবি করলেও দলটি ক্রমশ নিজের চরিত্র বদলে ফেলতে থাকে। অনবরত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নীতি গ্রহণ; মুক্তবুদ্ধি ও বাক্‌স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া; প্রশাসন, এমনকি বিচার ব্যবস্থার সর্বস্তরে দলীয়করণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সীমাহীন দুর্নীতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া; বিরোধী মতের প্রতি অযৌক্তিক অসহিষ্ণুতা, এমনকি নিষ্ঠুর আচরণ– কোনো কিছুই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকল না। মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়কে যেন ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করা হলো। আরও দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলের সমর্থক তরুণ প্রজন্মকে ন্যায়-নীতিবিবর্জিত ‘লাঠিয়াল বাহিনী’তে পরিণত করা হলো, যা জাতির জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু একটি সাম্য ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পরমতসহিষ্ণু, সংস্কৃতিবান জাতি গঠনে দেখানো হলো চরম উপেক্ষা ও অবহেলা। যারা এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তাদেরই দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; করা হয়েছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। তার ফলে আজকে বাংলাদেশের সমাজে প্রতিহিংসা ও সহিংস শক্তির প্রদর্শন ও আস্ফালনই মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল।

আমরা দেখলাম, একটি ন্যায্য বৈষম্যবিরোধী অহিংস আন্দোলনের বিজয় অর্জনের উদযাপন কী সহিংস রূপ ধারণ করল! সংবাদমাধ্যমসূত্রে যেসব ঘটনার কথা উঠে এলো, ভাবতে অবাক লাগে, আমার দেশের মানুষই এসব ঘটনা ঘটিয়েছে! এই পরিস্থিতির দায় যারা এত দীর্ঘদিন প্রখর দাপটে দেশ শাসন করলেন, তারা কি এড়াতে পারেন? স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর অসম্মান করবে– এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই অসম্মানের পথ তৈরি করে দেওয়ার পেছনে সদ্য ক্ষমতাচ্যুতদের অবদান তো অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘এ আমার, এ তোমার পাপ।’

আজকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান তাঁকে স্পর্শ করবে না। তিনি এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু আজকে ১৫ আগস্ট নিজেদের দিকে তাকিয়ে তাগিদ অনুভব করি ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার ৪৯ বছরের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হেয় করার অপচেষ্টার দায় মূলত ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ তাঁরই কন্যার নেতৃত্বে পরিচালিত তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের, যারা ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সঙ্গে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

প্রথম আলো