বখাটের উৎপাত, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বেড়েছে বাল্যবিয়ে
Share on:
শনিবার সমকালে নাটোরের গুরুদাসপুরে বাল্যবিয়ের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গত দুই মাসে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এক স্কুলের ১৯ ছাত্রীর বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। সবাই সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আশ্চর্যের বিষয়, শিক্ষক, স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান, প্রশাসন, এমনকি প্রতিবেশীর কেউই নাকি বিয়ের খবর জানতেন না! প্রতিবেদনমতে, এলাকায় বখাটের উৎপাত, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাজনিত কারণে অভিভাবকরা তাদের এভাবে গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন!
এই অনভিপ্রেত ঘটনার কারণ কী? কিংবা বিয়ের বয়স নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও এমন কাণ্ড কীভাবে সম্ভব? প্রশ্ন দুটির উত্তর অনুসন্ধান করলে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক দুর্নীতিসহ পুরো রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার চিত্রই উঠে আসে। রাষ্ট্র নির্ধারিত নীতি অনুসারে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছর। বিয়ের আনুষ্ঠানিক কাজ সম্পন্ন করতে প্রমাণ হিসেবে পাত্র-পাত্রীর জন্মসনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। অথচ এই ১৯ ছাত্রীর কারও বয়স ১৮ হয়নি। তার মানে, অভিভাবকরা তথ্য গোপন করেছেন এবং বিয়ে রেজিস্ট্রার ও নোটারি পাবলিকের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তাদের সহযোগিতা করেছেন।
বিয়ের নিবন্ধনে প্রথম ধাপে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগে। আবার কাবিননামা ওঠাতে গেলে নতুন ফন্দি ফাঁদে। বাংলায় হলে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা; ইংরেজিতে হলে বিশেষত বিদেশে যাবে বললে ৩ হাজার টাকা। স্রেফ ইংরেজির কথা বলে অতিরিক্ত টাকা নেয়। এই শ্রেণির রেজিস্ট্রার ও নোটারি পাবলিকের সহযোগিতায় ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে অভিভাবকরা সহজেই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের বিয়ে দিতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনও যুক্ত থাকে এসব বাল্যবিয়ে সংঘটনে।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের আরেকটি কারণ জানা যায়– সমাজে বখাটে ছেলেদের উৎপাত। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সমাজে বখাটেদের উৎপাতও বাড়ে। এতে বিশেষত মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং তাদের প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশি বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন ও সহিংসতা রয়েছে। বিশেষত গত দু্ই মাসে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভাবে সমাজে ভয়াবহ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর ভয়াবহ অর্থনৈতিক চাপ আসে। এতে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় গভীর উৎকণ্ঠা। এমন অনিশ্চিত ও অনিরাপদ পরিস্থিতিতে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েদের বোঝা বলেই মনে করেন। তাই অনেকে ‘ভালো প্রস্তাব’ কোনোভাবে হাতছাড়া করতে চান না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এ ধরনের বিয়ে দাম্পত্য জীবনে ব্যাপক কলহের সৃষ্টি করে এবং সমাজে তার মন্দ প্রভাব পড়ে।
অভিভাবকরা যেসব উৎকণ্ঠার কথা বলেছেন, তার মধ্যে আরেকটি হলো, পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। অনেকে এ সমস্যার জন্য বিশেষত মেয়েদের দোষারোপ করেন। কিন্তু গোড়া খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এটি কেবল ব্যক্তিদোষে ঘটে, এমন নয়। বরং এর সঙ্গে যুক্ত দারিদ্র্য ও অশিক্ষা।
বাল্যবিয়ে একটি পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। এটা খাদ্যচক্রের মতো সমস্যার মধ্যে ঘুরপাক খায়। এ পরিস্থিতির শিকার বেশির ভাগ মা মেয়েদেরও বাল্যবিয়ের দিকে ঠেলে দেন। এতে একটি ভুল বারবার সংঘটিত হয়। আর সমাজে সমস্যা আরও পোক্ত হয় এবং পুষ্টিহীন, অদক্ষ ও অসচেতন জনশক্তির হার বাড়তে থাকে।
বাল্যবিয়ে রোধ বাংলাদেশ সরকারের অনেক পুরোনো প্রতিশ্রুতি। দুই মাসে নাটোরের গুরুদাসপুরে ১৯ ছাত্রীর অল্প বয়সে বিয়ের ঘটনা রাষ্ট্রের এই প্রতিজ্ঞার ব্যর্থতারই চিত্র তুলে ধরে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করা, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান বাড়ানো, আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে এনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বাল্যবিয়ের মতো সমস্যা সমাজে রয়েই যাবে।