মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ৬, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর রোহিঙ্গা ইস্যুর বিপদ ও সুযোগ

Share on:

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে একাধিকবার পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন। একবার বলেছিলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনো অসুবিধা নেই, আমি জানি সেটা।’


আরেকবার বলেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো এক সাদা চামড়ার দেশের প্রস্তাব মেনে নিই তাহলে আমার ক্ষমতায় আসতে অসুবিধা হবে না।… পূর্ব তিমুরের মতো বাংলাদেশের একটি অংশ নিয়ে... তারপরে চট্টগ্রাম, মিয়ানমার এখানে একটা খ্রিষ্টান দেশ বানাবে, বঙ্গোপসাগরে একটা ঘাঁটি করবে।’

এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তিনি এর কারণ হিসেবে সেন্টমার্টিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ইঙ্গিত করতে ছাড়েননি। তাঁর এসব বয়ানের পেছনে রাজনৈতিক হিসাব থাকলেও আশঙ্কাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ সেন্টমার্টিন দ্বীপ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বন্দর, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বৈশ্বিক পাওয়ার হাউসগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক হুসাইন খানও বলেছেন, বাংলাদেশের তেলের খনি নাই; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান আছে।

২০১৭ সালে রাখাইনে জান্তা বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা, নতুন করে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার সীমান্ত অতিক্রম, মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও রাখাইনে রোহিঙ্গা, আরাকান আর্মি, জান্তা বাহিনীর ত্রিমুখী অবস্থান এবং বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের উচ্ছেদ– সব মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আরও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষ ও অনেক দেশি-বিদেশি সংস্থাও এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার বিষয়টি লেজেগোবরে করে তোলে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি প্রয়োজন, সেটা সেই সরকারের ছিল না। ফলাফল হাতেনাতে; গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

বিভিন্ন সময়েই মিয়ানমারের পক্ষে আকাশসীমা লঙ্ঘন, গোলার আঘাতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ২০১৫ সালে বিজিবি নায়েক রাজ্জাককে বাংলাদেশের সীমানা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছিল মিয়ানমার বর্ডার গার্ড-বিজিপি। চলতি বছরের মে মাসেই অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আরাকান আর্মি বা আরসা অপহরণ করে। প্রতিটি ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রায় নতজানু।

হাসিনা সরকারের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখানেই শেষ নয়। গত ৫ জুন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে চলাচলকারী নৌযানের ওপর মিয়ানমারের দিক থেকে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় দ্বীপটি অন্তত ৯ দিন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিরক্ষা নিরাপত্তার ফাঁক উন্মুক্ত হয়ে যায়।

দেখা যাচ্ছে, বহুদিন ধরেই নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে নাব্য সংকট চলছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে অন্তত তিন কিলোমিটার মিয়ানমার জলসীমার খুব কাছে বা ভেতর দিয়ে চলছিল এতদিন। প্রতিরক্ষা ছাড়াও সাধারণ চিন্তার জায়গা থেকেও দেশের দুটি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন নাজুকতা বা পরদেশ-নির্ভরতা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে গত কয়েক মাসের লড়াইয়ে মিয়ানমার জান্তা বাহিনী রাখাইনে আরাকান আর্মির হাতে প্রায় পরাজিত। আমাদের কেউ কেউ আশ্বাস দিচ্ছিলেন, আরাকান আর্মি জয়ী হলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও রোহিঙ্গা বা আরসা বা আরএসও বনাম আরাকান আর্মি যুদ্ধও হচ্ছে। তার মানে, নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না।

তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ কী? আমি মনে করি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগাতে হবে। মনে হয় না, মিয়ানমার আর্মি বা আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। বরং মিয়ানমারের বর্তমান যুদ্ধাবস্থা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।

যে কোনো সরকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার হলো নিজের নিরাপত্তা। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সম্মান ও অধিকারের সঙ্গে বসবাস নিশ্চিতের স্বার্থে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে একটি নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা সব দিক থেকে এবং রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।

প্রায় দেড় যুগ পর বাংলাদেশ জনগণের সমর্থিত সরকার পেয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো জটিল সমস্যাগুলো সমাধানের দাবি তাই এই সরকারের ওপর সবচেয়ে বেশি বর্তে।

দৈনিক সমকাল