ফিজিওথেরাপি কলেজ নির্মাণের ‘সকল বাধা’ কেটে যাক
Share on:
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের জাতীয় জীবনের জনগুরুত্বপূর্ণ সব খাতেই বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। স্বাস্থ্য খাতে এই বিশৃঙ্খলা এতটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে যে, সামর্থ্যবান মানুষ এখন দেশের চিকিৎসকদের ওপর ভরসাই রাখতে পারছেন না। অগত্যা পাড়ি জমাচ্ছেন উন্নত দেশগুলোতে।
সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিতে অক্ষম যারা, তারাও নিদেনপক্ষে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছেন। যদিও ‘সামর্থ্যবান’ এসব মানুষের বাইরেও সিংহভাগ দেশের মাটিতেই চিকিৎসার সুযোগ খুঁজে নিতে বাধ্য হন।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোর দিকে যদি দৃষ্টি দিই, এ খাতের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ আমাদের বিস্মিত না করে পারে না! স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া এবং ওষুধ খাওয়াকেই বুঝে থাকে অধিকাংশ মানুষ। প্রকৃত অর্থে এটি স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ মাত্র।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বা প্রতিরোধমূলক সেবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু চিকিৎসায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার বিকাশ আমাদের দেশে সেভাবে হয়নি বা হতে দেওয়া হচ্ছে না। তুলনামূলক তথ্য পর্যালোচনা করলে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর পেছনে এ খাতটির স্বার্থান্ধ অংশীজনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপই বহুলাংশে দায়ী।
চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টদের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ শারীরিক নানা ধরনের ব্যথা, ব্যথাজনিত উপসর্গ ও প্রতিবন্ধিতার শিকার। আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অন্যতম চিকিৎসাসেবা ‘ফিজিওথেরাপি’। বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোতে চিকিৎসাসেবায় ফিজিওথেরাপি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশে তা সেভাবে বিকশিত হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ২৬ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষই শারীরিক পরিশ্রম করেন না। অন্তত এক ডজন রোগের জন্য দায়ী শারীরিক পরিশ্রম না করার এই প্রবণতা। এই ভয়াবহতা থেকে মানবস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ফিজিওথেরাপির ব্যাপক প্রসার খুব জরুরি।
ব্যথা ও ব্যথাজনিত নানা উপসর্গ, বার্ধক্যজনিত সমস্যা, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, অবেসিটি, হৃদরোগ, মেরুদণ্ডে আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ নানাবিধ অসংক্রামক ব্যাধিতে বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশ আংশিক বা পুরোপুরি প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা এসব সমস্যায় প্রধান চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে ফিজিওথেরাপির কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে–পক্ষাঘাত, বিকলাঙ্গতা, সড়ক দুর্ঘটনা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা এবং বড় কোনো অস্ত্রোপচারের পর রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি রোগ, বাত ব্যথা ও পক্ষাঘাতের রোগীরা ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি গ্রহণ করে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছেন।
আজ ৮ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘কোমর ব্যথায় ফিজিওথেরাপি একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি’। প্রতিবছর দিবসটিকে ঘিরে সংশ্লিষ্টরা এর গুরুত্ব ও বিকাশের পথে বাধাগুলো তুলে ধরে প্রতিকার দাবি করেন। ব্যক্তিগতভাবে সত্তরোর্ধ্ব বয়সসীমায় পৌঁছে যেসব শারীরিক সমস্যা অনুভব করছি, বিশেষ করে ব্যথাজনিত উপসর্গে পীড়িত হওয়ার কারণে এর সম্যক গুরুত্ব অনুধাবন অনেক সহজ হয়েছে। বর্তমানে তরুণ থেকে বৃদ্ধ–অনেকেই যে এই ব্যথাজনিত উপসর্গে আক্রান্ত, তা দেশে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে।
কভিড-পরবর্তী অভিঘাতে এ উপসর্গে বহু মানুষ ধুঁকছে, যাকে চিকিৎসকরা লং কভিডও বলছেন। কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয়ে বাসযোগ্যতা হারানো, খাদ্যে ভেজাল, লাইফস্টাইলে পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে ব্যথাজনিত রোগের ব্যাপকতায় বিশেষজ্ঞরা কয়েক দশক ধরেই ফিজিওথেরাপির প্রাতিষ্ঠানিক কলেবর বৃদ্ধির প্রতি জোর দিয়ে আসছিলেন। বর্তমানে বিশ্বমানের সব বিশ্ববিদ্যালয় ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পিএইচডি, মাস্টার্স, ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রদান করলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরে ফিজিওথেরাপি শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা লজ্জার। অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যারা ফিজিওথেরাপি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই দেশে সরকারি চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। এর ফলে কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, কেউবা আবার পেশা পরিবর্তনও করছেন।
২০০৫ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু ফিজিওথেরাপিস্টকে সাময়িক সনদ দিতে শুরু করলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন আইনে ‘ফিজিওথেরাপিস্ট হতে হলে সরকার স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি নিতে হবে’ বলে উল্লেখ করা হলেও ফিজিওথেরাপিস্টদের জন্য দুটি সরকারি হাসপাতালে আছে মাত্র ১৯টি পদ। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সরকার এই শূন্য পদে অস্থায়ী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তা এখনও আটকে আছে।
এ রকম আরও ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ উঠে আসে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এসব থেকে আরও জানা যাচ্ছে, নতুন পদ তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) চেষ্টায় ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগ সাড়ে চার শতাধিক পদের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়ে তা আটকে দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিশ্বস্বীকৃত মাধ্যম ফিজিওথেরাপিকে বাংলাদেশে বিকশিত হতে না দেওয়ার প্রচেষ্টাটি আরও আগে থেকেই সক্রিয় ছিল বলে এর অংশীজন অভিযোগ তুলে আসছেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি নামে একটি স্বতন্ত্র কলেজের জন্য ২০০৭ সালে মহাখালীতে ৫ দশমিক ২৮ একর জমি দেয় সরকার। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন, সেখানে থাকা বস্তিও উচ্ছেদ করা হয়, কিন্তু কলেজ নির্মাণের কাজ এগোয়নি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা, হাইকোর্টের নির্দেশও উপেক্ষিত!
সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে, বাস মালিকদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে কীভাবে বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল ‘অজ্ঞাত কারণে’ বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি ও বহুজাতিক উড়োজাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় সুবিধা দিতে কীভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বছরের পর বছর লোকসান গোনে। রাষ্ট্রের টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী টেলিটককে লোকসানে ফেলে কীভাবে গ্রামীণফোনের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার পথ প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। জনস্বার্থকে বিঘ্নিত করে ব্যক্তি বা বিশেষ মহলের স্বার্থসিদ্ধির এমন বহু দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে।
দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো তাদের প্রচলিত প্রতিকারমূলক চিকিৎসা প্রদানের একচেটিয়া পন্থা বজায় রাখতে ফিজিওথেরাপির মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে যে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগে বিএমএ ও ফিজিক্যাল মেডিসিন সোসাইটির বাধা হয়ে দাঁড়ানো অন্তত সেটিই প্রমাণ করে। এ বাস্তবতা থেকে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এই ‘বিশেষ’ গোষ্ঠীর স্বার্থে ফিজিওথেরাপি কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ আর কত দিন আটকে থাকবে–অনেকের মতো এ প্রশ্ন আমাদেরও। এ প্রশ্নের কিনারা না হলে ফিজিওথেরাপি দিবস পালন নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই হবে না।