পুলিশ-সেনাবাহিনী কী রাজনীতির ‘রক্ষা কবচ’?
Share on:
গত ১৩ জুলাই পেশাগত কারণে যখন দেশ ত্যাগ করি, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনের তীব্রতা তখনই অনুভব করতে পেরেছি। কারণ রাস্তা বন্ধ থাকায় কয়েকটি জায়গায় যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারিনি। কিন্তু ভেবেছিলাম, সরকার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বসে একটা মীমাংসায় পৌঁছে যাবে। বিদেশে গিয়েও অনলাইনে দেখেছি আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠতে।
ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ষাটের দশক থেকে। যখন ছাত্র নই, তখনও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। সেসব আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন নিয়ে। নানা ধরনের সংঘাতময় চরিত্র আছে সেই আন্দোলনে। এর আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী একটা সময় বলেই দিয়েছিলেন– কোনো কোটা থাকবে না। কাজেই আন্দোলন সে সময় স্থিমিত হয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে সেই আন্দোলন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। উঠতেই পারে।
আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নই। এটাও জানি, আমার সন্তানদের এখন সরকারি চাকরির বয়স ছাড়িয়ে গেছে। নারী কোটা সমর্থন করি; যদিও নারীরা এখন শিক্ষাক্ষেত্রে এত এগিয়ে যে, তাদের কোটার প্রয়োজন রয়েছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। তবে দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী– এসব কোটার আমি পক্ষপাতী। প্রশ্ন হচ্ছে, কোটা কে নিয়ন্ত্রণ করে? নিশ্চয়ই সরকার তথা পাবলিক সার্ভিস কমিশন তথা আমলাতন্ত্র।
রাজপথে আমরা আন্দোলন করি বটে, সচিবালয়ের নথিতে কী ঘটনা ঘটে, তা জানি না। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কিছুদিন আগেই তোলপাড় হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস করে যেসব আমলা গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরিরত, তাদের কয়েকজনের নামও পাওয়া গেছে। এ তো গেল বিসিএসের ঘটনা। তার নিচে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়েগের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে, তাও আমাদের অজানা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির কথা আমরা জানি। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান কি হবে?
সরকার ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে বসে কোটা আন্দোলনের রাজনৈতিক সমাধানের পথে যায়নি। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের অপেক্ষায় থেকেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় দিতে দিতে পরিস্থিতি অনেক দূর গড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টও যে রায়ে ৯৩ শতাংশ মেধা ও ৭ শতাংশ কোটার স্বীকৃতি দিলেন, সেখানে নারী কোটা নেই, জেলা কোটা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব চাকরির সুষম বণ্টন। সে ক্ষেত্রে অনগ্রসর জেলাগুলোর জন্যও কিছু কোটা থাকে। কারণ জেলা শহর ঢাকার একজন ছাত্র এবং পঞ্চগড়ের একজন মেধাবী ছাত্র নানা কারণে সমান জায়গায় আসতে পারে না।
সেসব বিবেচনার বিষয়ও না হয় ছেড়েই দিলাম। সরকার রাজনৈতিক সমাধানের বদলে বল প্রয়োগের পথে গিয়েছিল। সেই বল প্রয়োগে প্রাণ গেল অনেক আন্দোলনকারী ও নিরীহ সাধারণ মানুষের। এর দায় কে নেবে? এর মধ্যে বেশ কিছু শিশু বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কে নেবে এ দায়? যেসব ছাত্র তাদের সহপাঠী বা বন্ধুদের হারিয়েছে, তাদের ক্ষোভ নিবারণ হবে কীভাবে?
কোটা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা। এই জনতা শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নয়; নানা কারণে ক্ষুব্ধ। এরা দ্রব্যমূল্যে ক্ষুব্ধ, দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ, অবিচারে ক্ষুব্ধ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর দাপটে ক্ষুব্ধ, শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দাপটে ক্ষুব্ধ। এই জনতা নানাভাবে আক্রান্ত। তাই কোটা আন্দোলন ঘিরে এ ক্ষোভ শতগুণে বাড়তে থাকে।
জনতার এই ক্ষোভের সুযোগে আরেকটি পক্ষ, বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী, যারা বিরোধী দল হিসেবে নানাভাবে নির্যাতিত, তারাও যে নামতে পারে– এ ভাবনা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে কি একেবারেই ছিল না? যারা অতীতে আগুন সন্ত্রাস করেছে, তারা কি সবাই মৃত? যারা মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারছে না, তারাও কি মৃত? সুপ্ত একটি শক্তি যে ক্রমাগত বিক্ষুব্ধ হয়ে একটা কিছুর অপেক্ষায় বসে আছে, সেসব কি শাসকগোষ্ঠী ভাবতে পারেনি? আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিরাট অংশ এ আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, তার কারণও কি তারা খুঁজে পায়নি?
একটা দেশের নিরাপত্তার জন্য শুধু পুলিশ কি যথেষ্ট? আমরা ভয়ার্ত, আক্রান্ত এবং নিহত পুলিশের চেহারাগুলো দেখেছি। এও দেখেছি, মানুষ কত নির্মম হলে আরেকজন মানুষকে হত্যা করে টাঙিয়ে রাখতে পারে! এই অশুভ শক্তির কথা কি আমরা জানি না?
সম্প্রতি এমপি আনার হত্যায় আমরা যতটুকু সংবাদ পেয়েছি, একজন মানুষকে শত টুকরো করে বস্তায় ভরে খালে নিক্ষেপ করা হয়েছে। জানা গেছে, ওই সংসদ সদস্য স্বর্ণ চোরাচালান করতেন। সাবেক পুলিশপ্রধান শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এক কর কর্মকর্তা ছাগলকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর বিপুল অর্থের সন্ধান দিয়েছেন। এসবই জনগণের ক্ষোভের বিষয়।
সরকারি অফিস-আদালতে কোথাও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। শিক্ষা ধসে গেছে; স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও করুণ। এসব কি সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না? বিরোধী দলহীন গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার কি বুঝতে পারছে না যে, অপর পক্ষ অস্ত্র শানিয়ে রাখছে? সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে যেভাবে শাসক দলের নমিনেশনের বিপক্ষে বিরোধী পক্ষকে উৎসাহিত করা হয়েছে, তাতে পরাজিত প্রার্থীরা সরকারের বিপক্ষেই কাজ করে যাবেন। যার জন্য দেখা গেছে শাসক দলের কর্মীরাও পথে নামেননি। এ নিয়ে বৈঠক ডাকলেও বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়।
যাই হোক, বিষয়টা এ রকম; আসলে রাজনৈতিক কাজটা কেউ করছে না; সরকারি দলও নয়, বিরোধী দলও নয়। তারা কাজ করে যাচ্ছে একেবারে নিজস্ব ছোট্ট গণ্ডির ভেতরে থেকে। আমার গৃহে কোনো সরকারি দলের কর্মী বা বিরোধী দলের কর্মী কেউ কখনও আসেনি তাদের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করতে। এমনকি এই আন্দোলনের যথার্থতা এবং বিরোধিতা দুটো প্রশ্নেই কারও একটি কথাও আমার কাছে পৌঁছায়নি। তাহলে কাকে নিয়ে রাজনীতি? রাজনীতি মানেই তো মানুষকে নিয়ে কাজ করা। মানুষকে বোঝাতে হবে, সঙ্গে নিতে হবে এবং তাকে সক্রিয় করতে হবে। এর কোনোটাই রাজনৈতিক দলগুলো করেনি। তারা নির্ভর করেছে মিডিয়ার ওপর। টেলিভিশনে কার কত ফুটেজ যায় তার ওপর। স্বভাবতই সরকারি দলের ফুটেজটাই বেশি যায়। অন্যদের ফুটেজ বিটিভি তো নয়ই, অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশনেও যায় না। শুধু সংবাদপত্রেই তাদের বক্তব্য আমরা শুনতে পাই।
দেশে এখন টকশো বলে একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে, যেখানে কিছু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। ঝগড়া শুরু হয়ে যায় সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আজকাল ক’জনই বা সংবাদপত্র পাঠ করে!
যখন দেশের বাইরে থেকে ফিরছিলাম– আমার স্ত্রী অসুস্থ, কন্যার বাড়ি থেকে ফিরছি; সংসদ ভবনের সামনে কয়েকজন সামরিক বাহিনীর জোয়ানকে দেখছিলাম। তাদের চোখে কোনো উগ্রতা ছিল না, বরং হাস্যোজ্জ্বল। কী ভাবছেন জানি না, হয়তো তারা ভাবছেন– এ তো রাজনৈতিক ব্যাপার, আমরা কেন? বারবার আমাদের নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়ে আসা হচ্ছে। এটিও সংগত মনে হয় না।
আমরা স্বৈরাচার এরশাদের সময় চেয়েছি সামরিক বাহিনী চিরতরে ব্যারাকে ফিরে যাক। রাজনীতি নেই, তাই লোকালয় অনিরাপদ। অনিরাপদ লোকালয়কে কি কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সেনাবাহিনী নিশ্চয়তা দিতে পারবে?