মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১৭, অগাস্ট ২০২৪

প্রশাসনে অনুগত সরকারি কর্মচারীরা এবং অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার

Share on:

১৯৬০ সালের ঘটনা। স্থান ইসরায়েল। অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার চলছে। কাঠগড়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনে তার যুক্তি, ‘আমি খুবই নম্রসম্র মানুষ। কোনো দিন মিথ্যা কথা বলিনি।


ওই মুহূর্তে আমার আসলে অন্য কিছু করার ছিল না। আমার কাছে অর্ডার আসত। সেগুলো কেবল আমি তামিল করেছি। সেসব নির্দেশনায় কী আছে, তা দেখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’ ১৯৬২ সালের ৩১ মে অ্যাডলফ আইখম্যানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কী এমন অপরাধ করলেন তিনি যে তাকে ফাঁসিতেই ঝোলাতে হলো?

অ্যাডলফ আইখম্যান ছিলেন অ্যাডলফ হিটলারের প্রধান আমলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার বিরুদ্ধে ইহুদি নিধনের অভিযোগ রয়েছে। মূলত অ্যাডলফ হিটলার সব নির্দেশনা কার্যকর করতেন আইখম্যানের মাধ্যমে। যদিও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে বিতর্কও। সেসব নিয়ে পরে বলছি।

বর্তমানে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এ প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, শেখ হাসিনার আমলে যেসব সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপরাধ করেছেন (এখানে ব্যক্তিগত অপরাধের কথা আমরা বলছি না), তাদের বিচার হবে কীভাবে? আদৌ কি তাদের বিচার করা সম্ভব? কারণ এসব অপরাধের সঙ্গে এত বেশি মানুষ জড়িত যে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কেন বলছি এ কথা? আসুন এক নজরে চোখ বুলিয়ে নিই, কী কী অপরাধ ঘটেছে রাষ্ট্রীয় মদদে।

এক. যে প্রজন্মের হাতে শেখ হাসিনার পতন ঘটল, সেই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভোটার হওয়ার পর কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, প্রিসাইডিং বা পোলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা, নির্বাচনের প্রার্থী, এজেন্টদের কি বিচারের আওতায় আনা যাবে? আর যেসব বিচারপতি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প পথ তৈরি না করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলে কলকাঠি নাড়লেন, তারাও কি অপরাধে অভিযুক্ত হবেন?

দুই. শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। গত ১২ আগস্ট বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত শাসনামলে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। এ সময়ে গুম হন ৬৭৭ জন। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের যেসব ঊর্ধ্বতন-অধস্তন কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং জনপ্রতিনিধি জড়িত, তাদের বিচার করা কি সম্ভব?

তিন. উন্নয়নের গল্পের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে। গত ৭ আগস্ট বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থ কারা পাচার করেছে? প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থ সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, দুবাই ও মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে কারা এ অর্থ পাচার করেছে, তাদের খুঁজে বের করতে পারে। বিচার করা কি সম্ভব?

চার. পুঁজিবাজার থেকে গত ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ১২ আগস্ট বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুঁজিবাজার থেকে জালজালিয়াতি, কারসাজি, প্লেসমেন্ট শেয়ার ও প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বিএসইসির দুই চেয়ারম্যান, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীরা জড়িত। এসব অপরাধের কি বিচার হবে?

পাঁচ. প্রকল্পের উন্নয়ন ব্যয়ে যে রেকর্ড হয়েছে, তাতে দুর্নীতি অবশ্যম্ভাবী। গত ৮ আগস্ট বণিক বার্তায় ১৫ বছরে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাত নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘মেগা প্রকল্পের বেশির ভাগই নির্মাণ ব্যয়ে বিশ্বে শীর্ষে।’ এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ২০০ কোটি টাকার বেশি, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এ দেশের মানুষ মনে করে, অধিকাংশ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। এ দুর্নীতির কি বিচার করা সম্ভব?

ছয়. জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত গণহত্যার বিচার হবে কীভাবে? ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রথমে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সড়কমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা আন্দোলন দমন/গুলির অর্ডার করেছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্যরা সেই নির্দেশনা কার্যকর করেছেন। এসব গুলিতে তিন সংখ্যার যে প্রাণহানি ঘটেছে, এই প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করা কি সম্ভব?

এছাড়া গত ১৫ বছরে দুটি বড় ঘটনা ঘটেছে, যার বিচার করা যায়নি। পিলখানা ও রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড। এ দুটি ঘটনায়ও রাষ্ট্রীয় মদদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে আলোচিত কিছু খুন রয়েছে, যার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিক সাগর সরোয়ার-মেহেরুন রুনি, কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু, স্কুলছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার বিচারে শাসকগোষ্ঠীর অনীহা লক্ষ করা গেছে।

এটা তো ঠিক, অ্যাডলফ হিটলার বা অ্যাডলফ আইখম্যান নিজ হাতে কাউকে খুন করেননি। অ্যাডলফ হিটলার নির্দেশ দিতেন অ্যাডলফ আইখম্যানকে। অ্যাডলফ আইখম্যান নির্দেশ দিতেন তার অধীন কর্মকর্তাকে। এভাবে ধাপে ধাপে কেবল নির্দেশনা চলে যেত। হত্যাকাণ্ড ঘটাত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা। তাহলে যিনি খুন করেননি, তিনি কি খুনের অপরাধে অপরাধী হতে পারেন?

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইউর্কার ম্যাগাজিনে অ্যাডলফ আইখম্যানের সংবাদ কভার করতেন হানা আরেনডট। পরে তিনি এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন, যা নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলে বিতর্ক। এ নিয়ে চলে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও। সেসব গবেষণায় বেরিয়ে আসে, অধিকাংশ মানুষই আসলে নির্দেশনা মেনে চলে। নির্দেশনা মানার সময় খেয়ালই করে না, কাজটি ভালো নাকি মন্দ। বিশেষ করে যারা চাকরি করেন, বড় পদে। আর যদি সরকারি আমলা হন, তাহলে তো কথাই নেই। বিশ্বস্ত আমলাদের অর্ডার ফলো করা ছাড়া বিকল্প কিছু করার থাকে না। মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের তো নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ আরো কম। ফলে যে যত বড় বা ছোট পদেই চাকরি করুক, আমরা চাই প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত হোক। কেবল নির্দেশনা পালন নয়, সেই কাজটি ন্যায় বা অন্যায়, নৈতিক বা অনৈতিক কিনা তা যাচাই করার মানসিকতা তৈরি হোক।

আমরা এরই মধ্যে জেনেছি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেছে, একে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা দাবি জানাই, গত ১৫ বছরে যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অর্থ পাচার, অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করা হলো, এরও বিচার করতে হবে। আর যেসব গণমাধ্যম এ অন্যায়কে কেবল সমর্থন করেনি, অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গেয়েছে, তাদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

শুধু এসবের বিচার করলেই হবে না। ভবিষ্যতে যাতে আইখম্যান বা অন্যায় নির্দেশের অনুগত আমলা/কর্মচারী তৈরি না হয়, সেই পথ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করতে হবে। যে সংবিধান চাইলেই পরিবর্তন করা যায়, যে সংবিধান একজন কর্তৃত্ববাদীকে বছরের পর বছর ক্ষমতায় বসিয়ে রাখে, যে সংবিধান বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অর্থ পাচার, অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি ও ভোটার ছাড়া নির্বাচনেও চুপ থাকে, সেই সংবিধান দিয়ে আমরা পুরনো দানবকে ফিরিয়ে আনতে পারি না। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, এর সাফল্য নির্ভর করছে বিদ্যমান সিস্টেমকে বাতিল করার ওপর, যা বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে সম্ভব না।

দৈনিক বণিক বার্তা