মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ২৭, সেপ্টেম্বর ২০২৪

পুরোনো প্রজন্ম কি এই ‘বিপ্লবের গভীরতা’ বুঝতে পারছে!

Share on:

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি স্বৈরাচারী ও নিষ্ঠুর সরকারকে পরিবর্তন করতে রক্তাক্ত বিপ্লব করেছে। এই বিপ্লব ছিল বৃদ্ধ, শিশু, যুবক, ধনী, দরিদ্র, রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক—সবার।


সবাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, জীবন দিয়েছেন এবং জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। শহীদদের কথা জাতি কখনো ভুলবে না। তাঁদের কাহিনি ভবিষ্যৎ স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকে থাকবে।

যেমন আন্দোলনে থাকা অবস্থায় এক নারী শিক্ষার্থী বলেছিলেন, ‘আমি আর ফিরে যাব না। আমার পেছনে পুলিশ আর সামনে বিজয়। হয় মরব, নয়তো জিতব।’ অথবা বিপ্লবে অংশ নিতে যাওয়ার আগে স্কুলছাত্র শহীদ আনাসের মাকে লেখা চিঠি। খাতায় লেখা প্রতিটি অক্ষর যেন একটি একটি প্রতিবাদ। পুলিশের গুলিতে সে শহীদ হয়। জাতি কখনো ভুলবে না। জাতির জন্য এরাই চেতনা হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে জাতির এই অমূল্য স্বাধীনতা অতীত স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আল্লাহ তাঁদের সর্বোচ্চ জান্নাত দান করুন, তাঁদের আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক।

রাজনৈতিক দলগুলো কি এই বিপ্লবের গভীরতা বুঝতে পারছে? যদি তারা বুঝত, তবে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে হাস্যকর সম্মেলন ডাকত না। তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল নতুন জাতি গঠনের জন্য তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা। তা না করে তারা নতুন জাতির স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে সরে থাকল। সত্য কথা বলতে গেলে তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়া হয়ে আছে। এই বিপ্লব বাংলাদেশের সাত কোটি তরুণের স্বপ্ন, যারা বিপ্লবের বোঝা একাই বহন করেছিল। পুরোনো দলগুলোর এতে কোনো দরকার ছিল না। নতুন বাংলাদেশের জন্য পুরোনো রাজনীতি যে অকেজো, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, এটি মেটামর্ডানিস্ট দর্শনের নেতৃত্বে ডিজিটাল যুগের বিপ্লব। অতীত যুগের চিন্তাবিদেরা বা নেতারা এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারেন। ড. ইউনূস যথার্থই বলেছেন, ‘এখন নতুন প্রজন্মের যুগ।

এই স্বাধীনতার মানে কী? আগের গণ–অভ্যুত্থান বা গণআন্দোলনের সময় সরকার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। ফলে সরকার দেশ শাসন করার জন্য ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। পরবর্তী সরকারগুলো দেশকে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ, শোষণ এবং পরাধীন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ নিয়মের দাসত্বে পরিণত করে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজব্যবস্থা মানুষের মানসিকতা, অনুভূতি ও জীবনধারাকে কলুষিত করেছে। ফলে গড়ে ওঠে একটি অনৈতিক ফ্যাসিবাদ সমাজ, যার বিষয়বস্তু হলো দমন-পীড়ন দ্বারা শাসন ও শোষণ। এর ফলে মানুষ সর্বস্তরে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি (৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) যমুনা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, সব চাঁদাবাজির কেন্দ্র আওয়ামী লীগকে হটিয়ে এখন বিএনপির প্রতিনিধিরা দখল করে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কারওয়ান বাজার, আন্তনগর পরিবহন, ফেরিঘাট, এমনকি বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রেহাই পায়নি। বিএনপি নেতাদের উচিত ছিল নিজে গিয়ে জোর করে দখল করা অফিসগুলোর দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া। দল থেকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয় আমরা দেখতেই পাচ্ছি। পুরোপুরি সেটি বন্ধ করা গেলে সেটি হতো রাজনীতিতে বিশাল একটি প্যারাডাইম শিফট। রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি এখন আর নেই, এখন রাজনীতি ছাত্রজনতার। সমাজে এখন দুটি আদর্শ—একটি ক্ষয়িষ্ণু ফ্যাসিবাদের অন্যটি বর্ধিষ্ণু সাম্যতা ও নৈতিকতার। আপনার পথ কোনটা? ফ্যাসিবাদী সমর্থিত দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান আর থাকবে না।

যেসব জনগণ ও দল দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে, তাদের উচিত দুর্নীতিমুক্ত নতুন সমাজ গঠনের সংকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের অবশ্যই নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে এবং আইনি উপায়ে তাদের ক্ষমতা এবং অর্থ বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। মনোভাবের এই পরিবর্তন আরেকটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন (প্যারাডাইম শিফট)।

স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক শাসন দমন ও নিপীড়নের জন্য সৃষ্ট আর্থসামাজিক কাঠামো থেকে দেশ নীতিগতভাবে মুক্ত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি, সমন্বয়কারীদের দৃষ্টিভঙ্গি জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অবশ্যই এক হতে হবে। ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা সবাই এক জাতি। এটাই সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন।’ সমাজের এ রকম আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধের পরিবর্তন। জনসাধারণের মতাদর্শের পরিবর্তনের মধ্যে মূল্যবোধের পরিবর্তন নিহিত, তার জন্য দরকার নিবেদিত মানসিকতার নেতা ও আহ্বায়ক। যে দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পর দেশকে নেতৃত্ব দিতে চায়, সেই দলগুলোতেই এ রকম নেতা আছেন, যিনি সর্বজনস্বীকৃত যুথোপযুক্ত যোগ্যতা রাখেন?

প্রথম এক মাসে প্রধান উপদেষ্টা ও ছাত্র সমন্বয়কারী নেতারা তাঁদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের আদর্শ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। নতুন বাংলাদেশ নতুন আবরণে পুরোনো বাংলাদেশ নয়। এটি মানুষের আচরণ, কর্ম এবং বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তির পরিবর্তন দাবি করে। এর মধ্যে কাঠামোগত পরিবর্তন, ব্যক্তিগত পরিবর্তন, প্রত্যাশা এবং অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত।

পরিবর্তনের মতাদর্শ বুঝতে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাহফুজ আলমের ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তাঁর সাম্প্রতিক আলোচনা থেকে পাঁচটি পয়েন্ট তুলে ধরছি। তিনি মনে করেন, এই বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে ১. ঐক্য ও ‘অনুপ্রেরণার ভাষা’, ২. যা কোনো এক ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে না বা ৩. তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যা বোঝেন না। ৪. তাঁরা সময়ের সন্তান ৫. গতানুগতিক চিন্তার দাস নয়। তাঁদের এ রকম চিন্তা আমি মনে করি উত্তর-আধুনিকতার (পোস্টমর্ডানিজম) বাইরে, আজকের মেটামর্ডানিজমের প্রতিফলন।

মেটামর্ডানিজম ডিজিটাল যুগের সাংস্কৃতিক দর্শন শব্দটি ১৯৭৫ সালে আমেরিকান সাহিত্যে একটি উদীয়মান সাংস্কৃতিক প্রবণতা বর্ণনা করার জন্য মাসুদ জাভারজাদে তৈরি করেছিলেন। তারপর থেকে, শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং প্রায়ই ইন্টারনেটের প্রতিটি কোণে আলোচনা করা হয়। মেটামর্ডানিস্ট চিন্তাবিদেরা আধুনিকতাবাদ ও পোস্টমর্ডানিজমের কাঠামোর বাইরে। তারা তাদের চারপাশের বর্তমান বিশ্বকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উপলব্ধি করে। তারা বাস্তববাদী আদর্শবাদ নিয়ে কাজ করে এবং কোনো গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ চিন্তাভাবনা বা কোনো গোঁড়া নিশ্চয়তা তাদের নেই। অন্য কথায়, তারা এসবের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করে। তারা স্বীকার করে যে তাদের সমাজের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এবং সরাসরি সমস্যার মুখোমুখি না হলে তারা সবার জন্য কাজ করতে পারবে না।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কীভাবে ছাত্র-বিপ্লব গণবিপ্লবে পরিণত হয়েছে, ছয় দফা দাবি এক দফা দাবিতে পরিণত হয়েছে। অথবা তারা কেন আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে নেয়নি। সব ক্রিয়াকলাপ, তাদের দেয়াল-সংস্কৃতি সবই মেটামর্ডানিজমের কাঠামো অনুসরণ করেছে।

বোঝা যায়, নতুন বাংলাদেশ নতুন আদর্শে সংজ্ঞায়িত। ছাত্র-বিপ্লবীরা বলেছেন, ভাষার মাধ্যমে আমাদের মতাদর্শের প্রতিফলন। নতুন মতাদর্শের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। এটি ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ভাষার সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে জনগণের ব্যবহারিক ভাষায় পরিবর্তনের বিপ্লব। অন্যভাবে ভাষার মাধ্যমে নতুন আদর্শ প্রতিফলিত হবে।

ভাষা কীভাবে নতুন বাংলাদেশের আদর্শের ধারক হতে পারে, তা বোঝানোর জন্য আমি কয়েকটি উদাহরণ ব্যবহার করতে পারি। বৈষম্যহীনতা একটি মতাদর্শ। এটা যদি সর্বত্র প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আপনার ভৃত্য এবং আপনার একই মর্যাদা রয়েছে এবং তাকে ‘তুই’ সম্বোধন বৈষম্য, সাংগঠনিক পর্যায়ে আপন পিয়নের সঙ্গে, অধীনস্থদের সঙ্গে ও ভাষার বৈষম্য দূর করতে হবে। সমাজে সবাই সমমর্যাদার। সাম্রাজ্যবাদী আমলের দাস ও প্রভুর সম্পর্কের বৈষম্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আমরা আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারি।

মানুষের পক্ষে অভ্যাস পরিবর্তন করা কঠিন। প্রতিরোধের পথে বাধা (রেজিস্ট্যান্স টু চেঞ্জ) বলে একটা কথা আছে কথা। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে প্রতিরোধ হতে পারে। ব্যক্তিগত কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়, ক্ষমতার ক্ষতি, চাকরি ও পদের জন্য হুমকি, সুবিধার ক্ষতি, নতুন দক্ষতা শিখতে হবে, এসব অজানা আশঙ্কায় কেউ বদলাতে চায় না। প্রত্যেকেই নিজের কমফোর্ট জোনের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। আমরা বহু বছর ধরে অর্জিত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করে আমাদের নিজস্ব পরিচয় তৈরি করি এবং আমাদের অনুমান এবং প্রত্যাশাগুলো আমরা যে কাঠামোর মধ্যে কাজ করি, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়। ব্যবসা, শিক্ষা বা শিল্পে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার বিষয়ে চিন্তা করুন পরিবর্তন করা কত কঠিন হয়। কাজের শৃঙ্খলায় কোনো উদ্ভাবন বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে ঐক্যমতে আনাটা অনেক কঠিন। তাহলে সমাজের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের কাজগুলো কতটা কঠিন হবে, ধারণা করতে পারেন?

তবে মনে রাখবেন, সমাজ অতীতে ফিরে যাবে না, সামনে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ। এটাই বিপ্লবের অঙ্গীকার এবং রক্তপাত ও আত্মত্যাগের পুরস্কার। বাংলাদেশের এই মেটামর্ডানিস্ট তরুণেরা এগিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছেন, ফেরত তারা যাবে না। আপনি যোগ না দিলে দেশ আপনার জন্য অপেক্ষা করবে না। যদি পূর্ববর্তী প্রজন্ম পরিবর্তনের এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ না করে, তবে আমি আরও বেশি অস্থিরতার আশঙ্কা করছি, যার পরিণতি সুখকর হবে না।

প্রথম আলো