প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে
Share on:
গত ৫ আগস্ট একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এর পর নানা ঘটনা-রটনার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেন। তাঁর সঙ্গে ও দুই-এক দিন পর শপথ নেন আরও ১৭ উপদেষ্টা।
পরের সপ্তাহে আরও চারজন মিলিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা এখন ২১।
বলা বাহুল্য, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক কাজ। কারণ এবারের সরকার একটি সফল নির্বাচন সম্পন্ন করার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের পথ এবং কৌশল বাতলে দেওয়ার শপথ নিয়ে এসেছে। তবে সবকিছুর আগে জরুরি ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা। কারণ শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দিন থেকে পরবর্তী তিন দিন দেশে কার্যত সরকার ছিল না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে সৃষ্টি হয়েছিল অরাজক পরিস্থিতি।
আমরা দেখেছি, উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণের পরও অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যেমন ১৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিনভর ঘটে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা। যদিও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটি ৫ আগস্ট রাতেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহ পর অন্তত এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আরও দ্রুত পদক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত ছিল।
যা হোক, সবাই এখন সংস্কার চাইছে। ন্যায্যতা ও প্রাপ্যতার দাবি নিয়ে মানববন্ধন করছে, উচ্চকিত হচ্ছে। চাকরিতে অস্থায়ী হিসেবে যারা আছেন তারা চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য আন্দোলন করছেন। চারদিকে কেমন যেন একটা ‘বঞ্চিত’ চেহারা নিয়ে লোকজন জড়ো হচ্ছেন। এই চাওয়ার পরিবেশটা কিন্তু খুব জরুরি। সরকারও বলছে, তারা সংস্কারের রূপরেখা দেবে এবং সংস্কার না করে কোনো ধরনের নির্বাচনের দিকে যাবে না। বিএনপিও বলেছে, তারা সরকারকে সংস্কারের সময় দেবে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে এতটাই ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল যে, সেটি টোকা দিলেই ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছেও আশা-আকাঙ্ক্ষার চাপ অনেকখানিই।
সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। এই সংস্কারের শুরু কোথা থেকে হবে? ৫ আগস্টের পর থেকেই দেশের অনেক কিছু এখন বিএনপির দখলে চলে গেছে। উপদেষ্টাদের শপথের আগে থেকেই সেটি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে গেছে নতুন করে চাঁদাবাজি। মানে, কে টাকা তুলবে বা কাকে টাকা দিতে হবে, সেই ব্যক্তির শুধু পরিবর্তন হয়েছে; বাকিটা আগের মতোই। বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যও এখন অনেকটা বিএনপি নেতাকর্মীর দখলে। বিএনপি মুখে সরকারকে সময় দেওয়ার কথা বললেও তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে না– সেটি মনে পুষে বিক্ষুব্ধ অবস্থা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী একে-ওকে চোখ রাঙাচ্ছেন। বুঝিয়েই দিচ্ছেন– এত দেরি তাদের সহ্য হচ্ছে না।
তার মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে পদত্যাগের হিড়িক। কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, আবার কাউকে চাপ দিয়ে করানো হচ্ছে। প্রায় সর্বত্র মবোক্রেসির চূড়ান্ত চর্চা চলছে; মব জাস্টিস হচ্ছে। একে-ওকে পাকড়াও করা হচ্ছে, ঘেরাও করা হচ্ছে; পদত্যাগে বাধ্য করছে; অপমান, হেনস্তা সবই চলছে। কোথায় কোথাও ডাকাতি, লুটতরাজের অভিযোগও উঠছে। এ অবস্থায় আসলে সরকার কী করছে? উত্তর হতে পারে, সরকার সংস্কার করছে। এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন, তাহলে সংস্কারের রূপরেখা কী? কাদের দ্বারা আসলে হবে এ সংস্কার?
উপদেষ্টাদের ‘সংস্কার কাজ’ হিসেবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যা বড় মাত্রায় হাজির হয়েছে তা হলো– পদচ্যুতি, নিয়োগ বাতিলের বিপরীতে নতুন নিয়োগ, এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে আরও নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পরের দিনই আবার তাদের পদোন্নতি। সে ক্ষেত্রে আবার প্রাধান্য পাচ্ছে ‘বঞ্চিত’ তকমা। কিন্তু বঞ্চিতদের ভিড়ে কারা পদোন্নতিতে শামিল হচ্ছে, সেটা কি খতিয়ে দেখা হচ্ছে? যেমন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে সব স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে। তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রতাপশালী প্রার্থীকে হারিয়ে জনগণের প্রকৃত ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদেরকেও পত্রপাঠ বাতিল করে দিয়ে কি জনরায়কে অবজ্ঞা করা হচ্ছে না?
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনও কাজে ফিরতে পারেননি। তাদের কাজের পোশাক পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে নতুন শক্তি তৈরি করার ঘোষণা এসেছে। কিন্তু এটি হলেই সংস্কার হবে? পুলিশের সঙ্গে জনগণের যে আস্থার সংকট এবং শত্রু-সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি কোন সংস্কারে আস্থায় আসবে– সেটির দিকেই মনোযোগী হতে হবে সবার আগে।
শুধু এটুকু বুঝতে পারি, মানুষ পাল্টালেই সংস্কার হবে না। বিষয়টি এমন যেন না হয়; আগে আওয়ামী লীগ ছিল; তার পরিবর্তে বিএনপি এলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে! পরিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে? স্বস্তি আসবে?
স্পষ্টত প্রক্রিয়াগত সংস্কারের ওপরেই সবার প্রচেষ্টা এবং মনোযোগ থাকতে হবে। এ সংস্কার হতে হবে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ এখানে ব্যক্তির চেয়ে ক্রিয়াটিই গুরুত্বপূর্ণ, যে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি বা বৈষম্যের সুযোগ তৈরি করছে। সেটি নিয়ে এখনও কাজ শুরু করেননি উপদেষ্টারা। এখনও ‘বাতিল’ করেই তারা কূল পাচ্ছেন না।
এখানে আরও একটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন, সংস্কার করার জন্য যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, তাতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এখানে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রয়েছে। তারা এ সংস্কার প্রক্রিয়াকে এত সহজে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না কিংবা নানা ধরনের প্রতিরোধ তৈরি হতে পারে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে কিংবা সেগুলোর সঙ্গে নানা ধরনের যুদ্ধ করে সংস্কার প্রক্রিয়াকে বের করে নিয়ে আসতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
আরেকটি বিষয় আমাদের আমলে নিতে হবে; সংস্কারের প্রতি সাধারণ মানুষের আচরণ। মানুষ সংস্কার চাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন জেঁকে থাকা ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ব্যবস্থার প্রতি কী ধরনের আচরণ করে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সংস্কারের মূল জায়গা দুর্নীতি, রাজনৈতিক আধিপত্য, স্বজনপ্রীতি, মতপ্রকাশে বাধাসহ সব ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থা থেকে মোটাদাগে মুক্তি। যদি আমরা প্রতিশোধের রাজনীতিতে সব সময় ও শক্তি ব্যয় করি, তাহলে যে স্বপ্ন নিয়ে এ অভ্যুত্থান হয়েছে, সেটির কী হবে?
আমি নিশ্চিত, একেবারেই নিশ্চিত যে উপদেষ্টারা হয়তো তাদের মতো করেই কাজ করছেন। তবে দেশে যে নানামুখী অরাজকতা বিরাজ করছে, সেটি থামানোর খুব বেশি উদ্যোগ দেখছি না। হয়তো চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেই কৌশল কাজ করছে না। এই মুহূর্তে দেখা দরকার সংস্কার প্রক্রিয়া সত্যিকার অর্থেই কারা করবেন? কারণ এটির সঙ্গে যে দেশের স্বস্তির প্রসঙ্গ বড্ড বেশি যুক্ত।