প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না
Share on:
‘প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। অপরাধ কখনো লুকানো যায় না। অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ারও কোন সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাকে তার পাপের প্রায়াশ্চিত্য করতে হয়’- এই কথাগুলো আমার বা বিশেষ কোন ব্যক্তির নয় বরং তা খুবই বাস্তব ও নির্মম। আর এই কথাগুলো প্রকাশ পেয়েছিল এক দায়রা জর্জের উপলব্ধি থেকে।
প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। সেদিন আমি স্থানীয় জজ কোর্টে উপস্থিত ছিলাম। দায়রা জজ নরেন্দ্র চন্দ্র দাসের আদালতে একটি ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ চলছিল। বিজ্ঞ দায়রা জজ মহোদয় নিজেই ভিকটিমকে ঘটনা সম্পর্কে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এ সময় তার মুখাবয়ব বেশ বিবর্ণ ছিল। বেশ বিরক্তির ভাব ছিল তার মধ্যে। একটা তীব্র ঘৃণার ভাবও তার মধ্যে লক্ষ্য করা গেল। তারপর তিনি এক দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে বললেন, ‘অভিযোগ মিথ্যা। এখানে রেপের মত কোন ঘটনায় ঘটেনি বলেই আমার ধারণা। বাদী-বিবাদীর মধ্যে পূর্ব তিক্ততার জের ধরে এ ধরনের কল্পিত ও বানোয়াট মামলা সাজানো হয়েছে বলে আমার কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। আপনারা পরস্পর আত্মীয়ও। তাই নিজেদের মধ্যে শত্রুতা না বাড়িয়ে একটা আপোষ রফা করে নিলেই ভালো হয়’। কিন্তু এ বিষয়ে ভিকটিম পক্ষের কোন সাড়া না পেয়ে তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বললেন, ‘আপনারা আমাকে গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যান মনে করলেন? আপনাদের মামলা চালানো আর না চালানোর মধ্যে আমাদের কোন লাভ-ক্ষতি বা মধ্যস্বত্ত্ব নেই। আমি একজন নারীর ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য করেই আপোষরফার কথা বলেছি। বিষয়টি আপনারা ভেবে দেখতে পারেন’। কিন্তু তারপরও ভিকটিক পক্ষের এ বিষয়ে কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা গেল না। বিষয়টি আমার কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হলো।
বিজ্ঞ দায়রা জজ মহোদয় কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর আদালতে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে এক নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করে বলতে শুরু করলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়, প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই কোন কোন ক্ষেত্রে ন্যায়-বিচার প্রাপ্তি দুরূহ হয়ে পড়ে। প্রভাবশালীদের কারণে পুলিশও নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের সনাক্ত করতে পারে না। প্রয়োজনীয় সাক্ষীর অভাব ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অসহযোগিতার কারণে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি বিধান করতে পারে না। তারপর প্রভাবশালী মহলের অনৈতিক প্রভাব ও মিথ্যা সাক্ষীর কারণে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিও শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। আবার ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধীও পার পেয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা প্রকৃতির বিচার থেকে রেহাই পায় না। বিশ^ প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় বিধানে তারা কোন না কোনভাবে শাস্তি পেয়ে থাকে। আর যাদের কারণে নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায়, তারাও প্রকৃতির বিচার থেকে রেহাই পায় না। অপরাধীর ক্ষমা নেই। তাদেরকে কোন কোনভাবে প্রায়শ্চিত করতেই হয়। এ এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা।
একজন সিনিয়র বিচারক তথা সেশন জর্জের এমন বক্তব্য রীতিমত বিস্মিত হওয়ার মত। তিনি আমাদের এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা, অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা ও আইনের অপপ্রয়োগের প্রতি রীতিমত ঘৃণার উদগীরণ করেছিলেন। যা ছিল তার এক নির্মোহ উপলব্ধি এবং আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বাস্তবচিত্র। একজন বিচারক আমাদের সমাজ জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে এমনভাবে উপলব্ধি করেছেন তা সত্যিই চিন্তাশীল এবং আত্মসচেতন মানুষের জন্য চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আবেদন রাখতে সক্ষম। কিন্তু আমরা যে একেবারেই আত্মভোলা।
নানাবিধ কারণেই আমাদের দেশ এখন অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ ও সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ শ্রেণি বিশেষকে বিবেকহীন করে তুলেছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থাকে অক্টোপাশের মত চেয়ে ধরেছে। মূলত, রাষ্ট্রের কোন সেক্টর এখন পুরোপুরি অপরাধ প্রবণতার বাইরে নেই। জনপ্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাও স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারছে না। সবকিছুতেই একটা শনির আছর পড়ার অভিযোগ এখন জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। আর দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে আশায় সে জ¦ালানো আগুনে রীতিমত ঘি ঢেলে দিয়েছে। মূলত, দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের বিচ্যুতির কারণেই দেশ এখন অপরাধীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং ক্ষেত্র বিশেষে অপপ্রয়োগ পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ফলে সাধারণ মানুষে প্রতিনিয়তই জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলত, সবকিছুই এখন নষ্টের দখলে চলে যেতে শুরু করেছে। আর ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমনই এক ক্ষমতাদর্পীর বাস্তব প্রতিবিম্ব হচ্ছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদ। সম্প্রতি তার সাথে আরো যুক্ত হয়েছেন ছাগল কাণ্ডের হোতা খ্যাত মতিউর রহমান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার পিএসসির সাবেক ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলী এবং আরজিনাসহ আরো অনেকেই। অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা এখন দেশে ছেড়েছেন। আর বেনজীর আহমদ ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা করে তিনি যে কুনজীর স্থাপন করে গেছেন তা এখন পর্যন্ত বিশ^ ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা। তার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে। আর সে অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে রয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। যা জাতি হিসাবে বহির্বিশে^ আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
মূলত, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালনের সময় নানা ঘটনায় বার বার আলোচনায় এসেছিলেন সম্প্রতি নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়া পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। ১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়া বেনজীর আহমেদকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’, যার বক্তৃতা ও বিবৃতি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে এমন সব বক্তব্য তিনি কখনোই দিতে পারেন না।
পুলিশের আইজিপি হিসাবে তিনি প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক মাত্র। আইন ও সংবিধানের প্রতি অনুগত থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া তার পেশাগত দায়িত্ব। তার কোন দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু তিনি চাকরিতে থাকাকালে এসব কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেন নি বরং সরকারি দলের অনুকূলে সব সময় কথা বলে নিজেকে সকল প্রকার আইনের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছেন। তার বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে তখনকার আইজিপি বেনজীর আহমেদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা, সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতির জনক-নোবডি ক্যান টাচ দেম!’
বিরোধী দলগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ বাহিনীকে সরকারি দলের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তাছাড়াও গত এক দশকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সময় ‘বিরোধী দল দমনে’ নানা পদক্ষেপ নিয়েও বার বার আলোচনায় এসেছেন তিনি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে বিষয়টির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক। যদিও গত জুনে একটি পত্রিকায় তার দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা সরকারি কোনো অনুসন্ধানের কথা শোনা যায় নি। ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার আবেদনে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ ও অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছে আদালত। এতে প্রমাণ হয় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইনজীবীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো পর্যন্ত আদালত বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের যে সব সম্পদ জব্দ বা ফ্রিজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, তিনটি শেয়ার ব্যবসার বিও অ্যাকাউন্ট, প্রায় ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। এসব তথ্য তার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত। কিন্তু তিনি এতোদিন ছিলেন একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও বেনজীর আহমেদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক জানিয়েছেন যে, তারা এখনই এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে গত মাসেই এক ভিডিও বার্তায় বেনজীর আহমেদ দাবি করেছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ মিথ্যা। অবসরের পরে তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা ‘হতাশাজনক ও দুঃখজনক’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ। যদিও তিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ততা’র জন্য। কিন্তু আইজিপি থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। যদিও তিনি ছাড়া আরো কয়েকজন কর্মকর্তা এবং র্যাবের ওপর ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এতে রাষ্ট্রের সম্মানহানি ঘটলেও সরকারের তেমন কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নি।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনজীর আহমেদ। এরপর ওই বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। ‘ক্ষমতাকে ব্যবহার ও প্রদর্শন করে একটা ভয়ের জায়গা তৈরি করেছিলেন তিনি। এটা করেছিলেন তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। এখন যেসব অভিযোগ উঠছে এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আগেও প্রকাশ হয়েছিল, কিন্তু সরকার তখন কান দেয়নি,’ বিবিসি বাংলাকে এমন তথ্যই দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন। যা খুবই যৌক্তিক বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
প্রাপ্ত তথ্যমেত, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের যে অবরোধ কর্মসূচি ছিল, সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ বা ডিএমপির কমিশনার ছিলেন বেনজীর আহমেদ। হেফাজতে ইসলামীর বিশাল সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে তখন আলোচনায় এসেছিলেন বেনজীর আহমেদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সেই সময় বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিরোধে শক্ত ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। সহিংসতায় অনেকে মারাও গিয়েছিলেন। তখন বিরোধীদলের কর্মীদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলী করার অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। যদিও সরকার বা পুলিশ বিরোধী দল দমনের সব অভিযোগ প্রত্যাখান করেছিল। ২০১৩ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনের সড়ক বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। তখন সেখানে আড়াআড়ি করে রাখা হয়েছিল বালুর ট্রাক, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিএনপি নেতারা এ ঘটনার জন্য তখনকার ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। পরের বছর ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। সেইবারও বালুর ট্রাক এনে খালেদা জিয়ার অফিসের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া বেনজীর আহমেদ ডিএমপি কমিশনার, র্যাব মহাপরিচালক ও আইজিপি থাকার সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বেশি কঠোরতার শিকার হয়েছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। এমনকি বিশেষ দলের লোক দেখলেই গুলী করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন-এমন অভিযোগই রয়েছে সাবেক এই আইজিপির বিরুদ্ধে। যা বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতি উৎসাহ দেয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
বেনজীর আহমেদ র্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় বহু বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তিনি কখনোই বিচার ‘বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ টার্মটিকে গ্রহণ করতেন না। ২০১৮ সালে ১৮ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ একটি ভুল শব্দ। ডিএমপি কমিশনার, র্যাব মহাপরিচালক এবং পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকার সময় বেনজীর আহমেদ এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন যেগুলো পুলিশ ও র্যাবকে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে সহায্য করেছে। এমনকি তাদের তা দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসে বেশ সহায়ক হয়েছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকার ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি সস্তা প্রচারণা। একটি বিশেষ মহল এই প্রচারণার সাথে যুক্ত। তিনি আরো বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা চেয়ে চেয়ে দেখবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কি অস্ত্র দেয়া হয়েছে হাডুডু খেলার জন্য?’ যা কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্য হতে পারে না। কারণ, অপরাধী পাকড়াও করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। আর বিচার করার জন্য রয়েছে বিচার বিভাগ।
পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকার সময় ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধ হলে কি আমাদের লোকজন বন্দুক ফেলে পালিয়ে চলে আসবে? এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলায় যে বক্তব্য দিয়েছেন তা রীতিমত চমকপ্রদ। তিনি, ‘তিনি (বেনজীর আহমদ) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। আমার মতে দেশের ইতিহাসে তিনিই মোস্ট ভিজিবল আইজিপি। তার মতো আর কোনো আইজিপিকে আমি এমন চলাফেরা করতে বা ভাষণ দিতে দেখি নি। তিনি যে পাওয়ারফুল সেটা বোঝাতে তিনি সবই করেছেন।’
বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে ঢাকার বোট ক্লাবে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশ হয় যে, ওই ক্লাবের সভাপতি তদানীন্তন আইজিপি বেনজীর আহমেদ নিজেই। ২০২১ সালের জুনে ওই ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে এবং ওই ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি পরবর্তীতে আটক হন। তারও পরে জেলে যেতে হয় ওই চিত্রনায়িকাকেও। কন্তু ঢাকার আশুলিয়ায় বোট ক্লাবের ছবি ও এর সভাপতি হিসেবে বেনজীর আহমেদের নাম আসার পর তা ঝড় তোলে সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে। এমনকি বিপুল অর্থ দিয়ে কিভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই ধরনের ক্লাবের সদস্য হতে পারেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জাতীয় সংসদেও। বিশেষ করে একটি বাণিজ্যিক ক্লাবের সভাপতি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আইজিপি থাকতে পারেন কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল তখন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন, বেনজীর আহমেদ তার পেশাগত কর্মকাণ্ডে যেমন বিতর্কিত হয়েছেন, তেমনি তার বিরুদ্ধে আগে অভিযোগ উঠলেও তিনি রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়েছেন। আর এভাবেই নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে নিজের বিত্ত-বৈভব অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছেন। আর এসব তার জ্ঞাত আয় বহির্র্ভূত হওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া আদলত তার সম্পদ জব্দের নির্দেশ প্রদান করেছেন। নিকট অতীতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইজিপিকে ইতোমধ্যেই দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে।
অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর অতি গোপনে দেশ ছেড়েছেন। জানা গেছে, তিনি স্পেনকে সেকেন্ড হোম হিসাবে বেছে নিয়েছেন। তুরস্কে নাকি সাবেক আইজিপি নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছেন। কারণ, তিনি বিচারের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন। আর তিনি অপরাধ করে পার পাওয়ার জন্যই দেশের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু একথা সত্য যে, যে কাজ করলে দেশে থাকা যায় না, তা কখনো নৈতিক ও সম্মানের নয় বরং তা ভাগ্যবিড়ম্বর একেবারে প্রান্তিক পর্যায়।
এক সময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইজিপির এমন বেহাল অবস্থায় বিজ্ঞ দায়রা জজ নরেন্দ্র চন্দ্র দাসের কথায় নতুন করে মনে পড়ে গেল। তিনি তার মন্তব্যে বলেছিলেন, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই বরং অপরাধী প্রাকৃতিক নিয়মেই শাস্তি পায়। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদ প্রকৃত পক্ষেই অপরাধী কি না তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সুযোগ না আসলেও সার্বিক পরিস্থিতি তাকে মোটেই ছেড়ে কথা বলে না। প্রকৃতির বিচার ও বাস্তবতা এমনই। কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে পারি না।