প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের ‘কৃতকর্মের ফসল’
Share on:
মানুষ আল্লাহ তায়া’লার সৃষ্টির মধ্যে সেরা জীব। দুঃখ আর সুখের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন।জীবনে কখনো সুখের সময় আসে আবার কখনো দুঃখ ও কষ্টের কঠিন সময় আসে। এটাই দুনিয়ার বৈশিষ্ট্যও বটে। নশ্বর এই পৃথিবীতে এমন কোনো মহা মানবের আগমন ঘটেনি যিনি তার পুরোটা জীবন শান্তি আর আনন্দে কাটিয়েছেন। এমনকি নবীগণও এমন ছিলেন না।
তাদের জীবনেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিপদ ও পরীক্ষা আসতো।বরং তাদের জীবনেই কঠিন বিপদ ও পরীক্ষা সবচেয়ে বেশি ছিলো। সাদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন মানুষের সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা হয়? তিনি বলেন: নবীগণের। অতঃপর মর্যাদার দিক থেকে তাদের পরবর্তীদের, অতঃপর তাদের পরবর্তীগণের। বান্দাকে তার দীনদারির মাত্রা অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। (সুনান ইবনু মাজাহা-৪০২৩)। তাই দুনিয়ায় বিপদে পড়ে হতাশ ও ভেঙে পড়া যাবে না। তদ্রুপ কোনো খুশিতে একেবারে আত্মহারা হওয়া যাবে না।
আল্লাহ তায়া’লা বিভিন্ন কারণে মানুষদেরকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদাপদ দিয়ে থাকেন।এরমধ্যে অন্যতম পরীক্ষাস্বরুপ।আল্লাহ তার মুমিন বান্দাদেরকে নানা রকম বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। বান্দা বিপদে পড়ে আল্লাহর প্রতি ইমান ধরে রাখতে পারে কিনন? কঠিন সময়ে আল্লাহর জন্য নিজের জানমাল সহ সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা কুরবানি করতে পারে কিনা? এগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য আল্লাহ তায়া’লা মাঝেমধ্যে বিপদ দিয়ে মুমিন বান্দাকে পরীক্ষা করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, আর আমি ভাল ও মন্দের মধ্যে নিপতিত করে তাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি যাতে তারা আমার পথে ফিরে আসে। (সূরা আরাফ-১৬৮)
দুনিয়ার একটা রীতি হলো মানুষ যাকে বেশি ভালোবাসে তাকে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখতে চায়,তাকে কাছাকাছি রাখতে চায়,তার বিপদাপদে পাশে থাকতে চায় আর মহান আল্লাহর রীতি হলো তিনি যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে বেশি বেশি বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন।আর এই পরীক্ষার মাধ্যমে এই মানুষটাকে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা বানিয়ে নেন। অনেক সময় মানুষের গুনাহের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিপদাপদ নেমে আসে। এগুলো মানুষের নিজেদের হাতের কামাই। গুনাহের কারণে শাস্তি স্বরুপ আল্লাহ বিভিন্ন বিপদ দিয়ে থাকেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তাতো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা-৩০)
এমন অনেক গুনাহ আছে যেগুলোর জন্য আল্লাহ বন্যা,মহামারি,খরা,অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ভূমিধস, শাসকের জুলমের মতো ভয়াবহ বিপদ দিয়ে থাকেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আল্লাহর বিধানাবলি পালনে উদাসীনতা প্রদর্শন করা।আল্লাহর হুকুম পালনে স্বেচ্ছাচারিতা করা।আল্লাহ বিমুখ হয়ে যাওয়া। এই বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বলেন, যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামাত দিবসে উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। (সূরা ত্বহা-১২৪) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন, কেউ যদি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যায় তাহলে তার রিজিক ঘাটতি দেখা দেয়,তার জীবন সংকুচিত হয়ে যায়। (তাফসীরে কুরতুবি ১২/২৫৯)
তারপর সবচেয়ে গুরুতর গুনাহ হলো যাকাত না দেওয়া। সমাজের বিত্তবানেরা গরিবদেরকে প্রতি বছর যাকাত দিবে। যাকাত গরিবের প্রতি দয়া প্রদর্শন নয় বরং বিত্তবানদের জন্য ফরজ ইবাদত। যদি কোনো সমাজে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন না থাকে তাহলে আল্লাহ তায়া’লা ওখানে বৃষ্টি দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে সম্প্রদায় যাকাত দিতে অস্বীকার করে আল্লাহ তাদের জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দেন। (আল মুসতাদরেক হাকিম)
সমাজে যেনা ব্যভিচার, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা বৃদ্ধি পেলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আরেকটা কারণ হলো সমাজে সুদ বৃদ্ধি পাওয়া। যে সমাজে সুদি লেনদেন ও ওজনে কম দেওয়া বৃদ্ধি পায় ওই সমাজে নানান ধরনের বিপদাপদ নেমে আসে। শুধু এগুলো ই বরং আরো কিছু গোপন গুনাহের কারণেও আল্লাহ সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলেন।
প্রকৃতি মহান আল্লাহর দান। বসবাসের উপযোগী করেই নশ্বর এই পৃথিবীকে তৈরি করা হয়েছে।মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিপদ আসার মাধ্যমে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ব্যত্যয় ঘটে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শক্তি পৃথিবীর আর কারো নেই যদি আল্লাহ রহম না করেন। তবে আগে থেকেই যদি আমরা নিজেরা সতর্ক থাকি, গুনাহ ছেড়ে আল্লাহর কাছে গুনাহ ছেড়ে তাওবা করি তাহলে আশা করা যায় আমরা এই শাস্তি থেকে মুক্তি পাবো। কারণ মানুষকে তাওবা ই পারে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, তাঁর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর; তিনিতো সর্বাপেক্ষা অধিক অনুতাপ (তাওবা) গ্রহণকারী। (সূরা নাসর-০৩)
গুনাহ ছেড়ে দিয়ে তাওবা করার পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বেশি বেশি দোয়া করা। বৃষ্টির সময় বেশি দোয়া করা।কারণ বৃষ্টি রহমত হলেও অনেক সময় এটি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার কারণে বৃষ্টি দেখলেই রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতেন। হাদিস শরীফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন যখন বৃষ্টি হতো তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন-হে আল্লাহ! আপনি যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারী হয় (সহীহ বুখারী-১০৩২)
দোয়া করার সাথে সাথে ধৈর্য ধারণ করা। বিপদের সময় সবচেয়ে বড় আমল হলো ধৈর্য ধারণ করা। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। ধৈর্য শীলদেরকে আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে অগণিত পুরস্কার দেওয়া হবে।আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ধৈর্যশীলদেরকে অপরিমিত পুরষ্কার দেয়া হবে। (যুমার-১০)
এ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা। আল্লাহর স্মরণের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নামায পড়া নিয়মিত ফরয নামাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু নফল নামায পড়া। কুরআনে নামাযের মাধ্যমেই সাহায্য প্রার্থনা করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেন, হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলগণের সাথে আছেন।(সূরা বাকারাহ-১৫৩)। দুর্যোগের সময় আল্লাহর স্মরণের আরো অনন্য উপায় হলো ইস্তিগফার করা ও তাসবিহ পাঠ করা। হাদিস শরিফে এসেছে, প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে চলে যেতেন এবং নামাজে দাড়িয়ে যেতেন। (মিশকাত শরিফ: ৬৯৬)। সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের সালাফদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদে-মুসিবতে তারা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৪৫)।
সর্বশেষ সবকিছুর জন্য তাকদীরের উপর বিশ্বাস করা। সর্বোচ্চ সান্ত্বনার জায়গা হলো তাকদীর। আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই আল্লাহ মানুষের তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর তাকদীর অনুযায়ী ই সবকিছু ঘটে। এটা ইমানের মৌলিক বিষয়। তাকদীরের উপর বিশ্বাস না থাকলে আল্লাহর প্রতি ইমানের ঘাটতি চলে আসতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার দিক হলো দুনিয়ার দুঃখ কষ্টগুলো স্থায়ী না।এটা ভেবেই মুমিন তার হৃদয়ে প্রশান্তি খুঁজে পায়। আল্লাহর প্রতি ইমান বহুগুণে বেড়ে যায়। হতাশা থেকে মুক্তি পায়। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুন। আমিন