‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ’
Share on:
বাংলা ভাষায় বহুল কথিত প্রবাদ বাক্য, ‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ’। কথাটির মর্মার্থ হলো, কেউ যদি পাপ অর্থাৎ- অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সেটি তার জন্য অবশেষে দুঃসহ বেদনা ডেকে আনে।
সুখ-সুবিধা দূরের কথা, জীবন হয়ে ওঠে অপমান, অসম্মান ও অপযশের। পাপের মাত্রা যত ভারী হবে, তত বাড়বে যাতনা। এমনকি নির্মম মৃত্যুও শেষ পরিণতি হতে পারে। ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণ হবে, পরিণতি হতে পারে তত ভয়ঙ্কর। সাধারণ নাগরিক যে অপরাধ করে, হয়তো তার ফল হতে পারে স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সে হয় শাসক, তাহলে পরিণতি হতে পারে অস্বাভাবিক। সদ্য পতিত স্বৈরাচার কত নিষ্ঠুর, নির্মম ও নৃশংস হতে পারে তা অকল্পনীয়। তাদের অস্বাভাবিক ক্ষমতালিপ্সাকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন গণতন্ত্রের খোলসে।
আজ ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিয়োগান্তক পরিণতির দিন। এদিন এক নির্মম-নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এদিন সপরিবারে নিহত হন। রক্তপাত কোনো দিন সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ শান্তি চায়। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। বাংলাদেশের মানুষও দেশে অশান্তি, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চায় না। তবু ১৫ আগস্টকে কেন মানুষ মেনে নিয়েছিল সে এক করুণ ইতিহাস। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তানের ‘আধা-ঔপনিবেশিক’ আমলে শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষের উপর আরোপিত অন্যায়-অত্যাচার ও অসমতার প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরেও গণতন্ত্র কায়েম হয়নি। গণতন্ত্র অস্বীকার করার পরিণতি হিসেবে কবর হয় পাকিস্তানের। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় মানুষের মনে গণতন্ত্রের চির আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন পাকিস্তান আমলে, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করলেন। গণতন্ত্রের মূল কথা শক্তি নয়, সম্মতি। নির্বাচনব্যবস্থা সম্মতি প্রকাশের একমাত্র পন্থা। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে ছিটেফোঁটা বিরোধী প্রতিনিধিত্ব তারা মেনে নেয়নি। নির্বাচনে কারচুপি করেছে।
গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়, এটি শুধু একটি তন্ত্র বা ব্যবস্থা নয়, একটি জীবনবোধ। গণতন্ত্র যদি হৃদয়ের গহিন-গভীরে প্রোথিত না থাকে তাহলে রাজনীতিতে তথা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। শেখ মুজিব তারস্বরে গণতন্ত্রের কথা বলতেন। গণতন্ত্রের জয়গান গাইতেন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতেন। সমগ্র রাজনীতি যখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদলে প্রতিষ্ঠিত হলো তখন কী তিনি গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলতেন? পাকিস্তান আমলে তার মুখে গণতন্ত্রের খৈ ফুটলেও বাংলাদেশ আমলে তার বুকে কী গণতন্ত্রের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে? তার ভাষায়, তার বক্তৃতায় যে আমিত্ব প্রকাশিত হয়েছে, তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। ১৯৭৪ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, ‘একটু একটু ছেলে, নাক টিপলে দুধ বের হয়, রাজনীতি করে। আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। লাল ঘোড়া দাবড়ে দেবো।’ জাসদ নেতা আ স ম রব ও সিরাজুল আলম খানকে লক্ষ করে তিনি এসব কথা বলেছিলেন। তার এ কথা ‘কথার কথা’ ছিল না। দিন শেষে তিনি সত্যি লাল ঘোড়া দাবড়ে দিয়েছিলেন। নাগরিক স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল। গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার অপরাধে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাম ধারার নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে শেখ মুজিব দম্ভভরে সংসদে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?’ অবশেষে সব মত ও পথ দলন করে বাকশাল কায়েম করেছিলেন। একনায়কতন্ত্রের তখনকার মূলমন্ত্র ছিল- ‘এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এসব কার্যব্যবস্থা ও আচার-আচরণ কী গণতন্ত্রের কথা বলে?
পিতা ও কন্যার কী অপূর্ব মিল! একটি ১৫ আগস্টকে তারা শুধু হত্যাযজ্ঞ হিসেবে দেখেছেন। খতিয়ে দেখেননি এর পেছনে কী মৌলিক কারণ ছিল। সেনাবাহিনীর কী দুঃসাহস যে, তার মতো সুউচ্চ ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে! সেই নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব অবস্থাকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আনন্দ উল্লাস প্রত্যক্ষ করেছি। আর এখন তার কন্যা শেখ হাসিনার পলায়নে জাতিকে আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হতে দেখলাম। উভয়ের একই পরিণতি। সবাই জানি, ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নেন। যে ড. কামাল হোসেন তাকে নেতৃত্বে স্থাপনে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেন, তাকে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত করেন। ঘটনাবলির দীর্ঘ বিশ্লেষণ এই অবয়বে সম্ভব নয়। শুধু মনে করিয়ে দিই, ১৯৯১ সালের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তারা জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। চরম প্রতারণা ও মিথ্যাচারকে সম্বল করে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির বিভাজন তাদের বিজয়ের মূল কারণ ছিল। সে সময়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে তুষ্ট করে ও নির্ভরতা দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্ব যেসব কথাবার্তা বলেছিল তা সংবাদপত্র ঘাটলে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে দ্য ইকোনমিস্টের ভাষায়- বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকা ও তাদের অনুসৃত কৌশলে আওয়ামী লীগ সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীতে তার স্বীকৃতি মিলে। ক্ষমতায় আসার পর পর তারা বুঝতে পারে, বাংলাদেশের জনগণের ভোটে তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা অসম্ভব। তাই জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। সম্মতি নয়, কঠোর শক্তিপ্রয়োগে তারা দেড় দশক দেশ শাসন করে। অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন ও গুম-খুন তাদের ক্ষমতায় থাকার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। সাথে যুক্ত হয় মিথ্যাচার ও দুর্নীতি। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় থাকা হয়ে ওঠে একমাত্র লক্ষ্য। বিগত আওয়ামী শাসনামলের দুঃখ-বেদনার মহাকাব্য হয়তো ভবিষ্যতে রচিত হবে। এখন এতটুকু বলে শেষ করি যে, তার পিতার মতো শেষের দিনগুলোতে তিনি যে নির্মম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ২১ বছর পর মায়াকান্না করে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। আগামী বহু বছরেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার আশঙ্কা নেই। তবে আগামীতে যদি বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন দেখতে না পায় এবং সম্মতির মাধ্যমে দেশ শাসন করতে না পারে তাহলে অঘটন ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের গণবিপ্লবে এখন দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের কাজ চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ও স্থাপিত সরকার যৌথভাবে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু বিতাড়িত গণবিরোধী শক্তি বসে নেই। প্রাথমিক হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের গলিপথ খুঁজছে। হাসিনাপুত্র জয় বলেছিল- তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। পল্টি মেরে এখন বলছেন, আগামী নির্বাচনে আসবেন তারা। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার একটি বার্তা ইতোমধ্যে ফাঁস হয়েছে। সেখানেও গণবিপ্লবের স্বীকৃতি নেই। নেই দুঃখ-অনুতাপ। জয় সর্বশেষ বিবৃতিতে যা বলেছেন, তা বিপজ্জনক। তার দাবি- তার মা শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী। তিনি পদত্যাগ করেননি। একই মনোভাব যদি পোষণ করে নয়াদিল্লি তখন হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়। ভারত প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র বলে গণবিপ্লবকে দেখলেও তারা এখন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভেচ্ছ জানিয়েছে। সেই সাথে লক্ষণীয় যে, সংখ্যালঘিষ্ট জনগণের উপর কথিত অত্যাচার সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়েছে। এখন বাংলাদেশে তথাকথিত সংখ্যালঘুদের যে আন্দোলন চলছে, তা দিল্লির নির্দেশে হচ্ছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করে।
বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে কিভাবে শেখ মুজিব ও তার কন্যা শেখ হাসিনার অন্যায়-অত্যাচার এবং পাপাচার দেশকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে গেছে। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না তা শেখ মুজিব জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এখন হাজারো চ্যালেঞ্জ। প্রথম বিপদ শান্তিশৃঙ্খলা। তবে আশার কথা- ক্রমে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারে ‘যৌক্তিক’ সময় দিতে একমত হয়েছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। আশা করি, প্রফেসর ইউনূসের মতো ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে বাংলাদেশ হয়তো মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছতে পারবে।
ফিরে আসি আবার ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে। ইতিহাসের গতি স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে। সময় ও সত্য কাউকে ক্ষমা করে না। বিগত আওয়ামী শাসন প্রাথমিক (১৯৭১-৭৫) এবং চূড়ান্ত আমল (২০০৯-২৪) অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে পরিপূর্ণ। ১৯৭৫ কিংবা ২০২৪ তাদের সেই পাপাচারের বিষ গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। তারা এমন কোনো পুণ্য করেনি যার ফলে তারা ক্ষমতায় পুনঃস্থাপিত হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে ১৫ আগস্ট শোক দিবসের ছুটি বাতিল করেছে। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক আবেদনের বিপরীতে তারা যেভাবে দেড় দশকে দেশকে বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে, তাতে জনগণ রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মানুষের সেই ক্রোধকে প্রত্যক্ষ করেছে। তাই আজ ১৫ আগস্টে পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়- ‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ’। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পাপের পরিবর্তে পুণ্যে ভরে তুলুক দেশ, এ প্রার্থনা সব মানুষের।