মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১৬, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভাস্কর্য উপড়ে ফেলার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক আধিপত্য

Share on:

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বড় বড় খবরের ভিড়ে ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে স্থাপিত ‘থেমিস’ উপড়ে ফেলার খবর খুব বেশি মনোযোগ পায়নি। অবশ্য আগের দিন ৬ আগস্টই বিক্ষুব্ধ জনতা ভাস্কর্যটি ‘আহত’ করে গিয়েছিল।


নগর পরিসরে একটা স্থাপনাও কীভাবে রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে, ভাস্কর্য থেমিস এর তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেমিসকে স্থাপন করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে। রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’-এর আদলে এটি নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর মৃনাল হক: চোখে কাপড় বাঁধা নারীর ডান হাতে তলোয়ার, বাঁ হাতে দাঁড়িপাল্লা। তলোয়ারটি নিচের দিকে নামানো আর দাঁড়িপাল্লাটিতে পরিমাপ করার ভঙ্গি।

কিছুদিন পর হেফাজতে ইসলাম ভাস্কর্যটিকে ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি’ আখ্যায়িত করে অপসারণের দাবি করে। এক পর্যায়ে ২০১৭ সালের ২৫ মে রাতে সেটা অপসারণ করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে

সংস্কৃতিকর্মীদের একাংশ বিক্ষোভ করলে ২৭ মে ভাস্কর্যটি অ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়। কিছুদিন পর সেই বিতর্ক থেমে যায়।

এটা স্পষ্ট হয়েছিল, ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা বা রাখতে চাওয়ার দাবি উঠেছিল ‘রাজনৈতিক’ জায়গা থেকেই। হেফাজতে ইসলামের যুক্তি ছিল, ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূর্তি থাকতে পারে না। অন্যদিকে সংস্কৃতিকর্মীদের যুক্তি হলো, এভাবে ভাস্কর্য অপসারণের দাবি মেনে নিলে দেশে শিল্পকর্ম থাকতে পারবে না।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে, সারাদেশে এমনকি ঢাকা নগরীতে আরও অনেক ভাস্কর্য থাকলেও কেন হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত থেমিস নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আবার ভাস্কর্যটি অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হলে বিতর্করত দুই পক্ষই ধীরে ধীরে থেমে যায়।

এখানে সম্ভবত পরিসরও গুরুত্বপূর্ণ। যে নগর পরিসরে দুই পক্ষই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, তা উভয়পক্ষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায়, দুই দশক ধরে বিভিন্ন ঘটনায় দুটি পক্ষ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। বলা যায়, দুটি পক্ষের মধ্যে নগর পরিসরে আধিপত্য বিস্তারের একটা রাজনীতি রয়েছে।

আমরা জানি, নগর পরিসরের রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কে ডেভিড হার্ভের ‘স্পেশীয় টেম্পোরালিটি’ শীর্ষক তত্ত্বে বলা হয়েছে, ‘পরিসরের ধারণাটি খোদ সার্বভৌম, সম্পর্কযুক্ত বা আপেক্ষিক হতে পারে না। এর যে কোনো একটি বা সব একসঙ্গে হতে হলে নির্ভর করতে হয় পরিস্থিতির ওপর। পরিসরের সঠিক ধারণায়নের সমস্যাটি সমাধান করা যেতে পারে এর প্রতি সম্মান দেখানোর সহিত মানবচর্চার মাধ্যমে।’ এটা তখনই জাতীয়ভাবে সম্পৃক্ত হয় যখন স্থান এবং সময়ের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলো যুক্ত হয়।

এখানেও যেখানে থেমিসের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়, সে স্থানটিও নগর পরিসরের মানুষের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্ট এমনিতেই সর্বসাধারণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পাশেই রয়েছে জাতীয় ঈদগাহ মাঠ, যা ধর্মীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পশ্চিম দিকে রয়েছে হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদ। কাছেই রয়েছে প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়, যা রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে অবস্থানগত দিক থেকেই থেমিসের ভাস্কর্যটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

লক্ষণীয়, ভাস্কর্য নিজে কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে না; যেমন পারে না কোনো অর্থ তৈরি করতেও। আমরা বিভিন্ন অর্থ আরোপের মাধ্যমে তা অর্থময় হিসেবে গড়ে তুলে বিতর্কের সৃষ্টি করে থাকি।

থেমিসের পক্ষ-বিপক্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সংগ্রামের বিষয়টিও লক্ষ্য করা প্রয়োজন। থেমিস নিয়ে যে নির্দিষ্ট সময়টাতে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, সে সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারাদেশে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেই সময়ে ৬ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে ইসলাম প্রথম আন্দোলনের ডাক দেয় এবং পরবর্তী সময়ে ১১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসে। সংলাপে শেখ হাসিনা হেফাজতের দাবির প্রতি সায় দিয়ে বলেন, হাইকোর্টের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্তি তাঁরও পছন্দ নয়। পরে এ নিয়ে তিনি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে কথাও বলেন।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপনের কারণ হিসেবে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনা করে আমি ভাস্কর্যকে এমনভাবে তৈরি করি, যাতে আমাদের সংস্কৃতির গৌরব বজায় থাকে। আদালত প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি শাড়ি পরিহিত, থেমিসের একটি বাংলাদেশি প্রোটোটাইপ রূপান্তরিত করা হয়। এটির মধ্যে একটি সাহসী বার্তা অনুকরণ করা হয়।’

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত এবং স্থানান্তরিত ভাস্কর্যটির নির্মাতার বক্তব্য ছিল, ভাস্কর্যটি ন্যায়বিচারের প্রতীক। শাড়ি পরানোর বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, এটি গ্রিক দেবী নয়, বাঙালি নারীর ভাস্কর্য।

লক্ষণীয়, ভাস্কর্যটি যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে মাত্র ২০০ হাত দূরেই অ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়, তখন সেটি নিয়ে বিতর্ক স্তিমিত হয়ে যায়।

যাহোক, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে থেমিসের অপসারণ এবং এখনও এ নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের আপাত নীরবতার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয়েছে, বিতর্কের মূল বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক আধিপত্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, নির্দিষ্ট নগর পরিসরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার রাজনীতি। তবে ভাস্কর্যটিকে রাজনীতির বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচনা না করে যদি দুই পক্ষই মধ্যপন্থা অবলম্বন করত, তবে এটি ঢাকার রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতীকায়নের উদাহরণ হিসেবে থেকে যেতে পারত।