নাসরাল্লাহ হত্যাকাণ্ড, ইরান ভয় পেলে জয়ী হবে ইসরায়েল
Share on:
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন শুক্রবার নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী দিনগুলোই মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবতা তিনি বুঝতে পারেননি। এমনকি তখনও তিনি আশা করেছিলেন, হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল উভয়ে খাদের কিনার থেকে ফিরে আসবে।
কিন্তু আমরা দেখলাম, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। যুদ্ধের ১১ মাস পর অবশেষে তারা সেই খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে এবং এমন সংকটে পড়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। ইরান যদি কেবল নিন্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়বে।
বাস্তবতা বলে, ইরান হয়তো হিজবুল্লাহকে ক্ষয়ক্ষতি মেনে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। যদিও গাজায় যুদ্ধবিরতি আসেনি। অন্যদিকে ইরান যদি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলা চালায়, সেটাও অর্থবহ হতে হবে। ইরানের জানা আছে, তারা এমন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে, যার উচ্চতর প্রযুক্তিসম্পন্ন অস্ত্র আছে এবং যার গোয়েন্দা দক্ষতা অসাধারণ। এটা স্পষ্ট– ইসরায়েলের গোয়েন্দারা হিজবুল্লাহর গভীর পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তেহরানেও এমনটি ঘটেছে।
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান যখন নির্বাচিত হলেন তখন প্রত্যাশা ছিল, পশ্চিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ আব্বাস আরাগচি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের জন্য নিউইয়র্কে পুরো এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন। তিনি জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামির মতো ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য আলোচনা পুনরায় চালু করতে তাদের রাজি করানো। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে পারমাণবিক এ চুক্তি বাতিল করেন।
কিন্তু হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর সংস্কারপন্থিদের পক্ষে ইরানের সামরিক বাহিনীকে ওই রকম কোনো চুক্তিতে রাজি করানো অনেক কঠিন হয়ে গেল। কারণ এখন সুসম্পর্ক স্থাপনের সময় নয়। ইতোমধ্যে পেজেশকিয়ান অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলের হাতে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ হত্যায় অবিলম্বে প্রতিশোধ না নেওয়ার জন্য পশ্চিমা আবেদন শুনে খুব একটা লাভ হয়নি। পেজেশকিয়ান বলেন, তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল– গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং জিম্মি ও ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে। অথচ চুক্তিটি বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ ইরানের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে নিতে যথেষ্ট চাপ দিতে অস্বীকার করে। পেজেশকিয়ানের জন্য এটা হতাশার। হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর সঙ্গে যে যুক্তরাষ্ট্রের হাত নেই– এটি তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমনকি নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহ নেতাকে নিউইয়র্কে থেকেই হত্যার নির্দেশ দেন; সেই বোমাও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া, যেটি বিস্ফোরণ হয় বৈরুতে।
হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিবৃতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শনিবার মুসলমানদের আহ্বান জানিয়ে লেবাননের জনগণ ও গর্বিত হিজবুল্লাহর পাশে যে কোনো উপায়ে দাঁড়াতে বলেন এবং (ইসরায়েলের) শয়তানি শাসন রুখে দিতে বলেন।
নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড ওয়াশিংটনের জন্য কূটনৈতিক অবমাননা এবং মিত্র নিয়ন্ত্রণে তার অক্ষমতা বা তার প্রতি মিত্রের অবিশ্বস্ততার শামিল। নেতানিয়াহু ভাবছেন, নিউইয়র্কে মার্কিন কূটনীতিকদের তিনি বোকা বানিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের কৌশল পরিকল্পনামন্ত্রী রন ডার্মার ও নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক হয় যে, ইসরায়েল ২১ দিনের যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে। কিন্তু এ ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতানিয়াহু বলেন, এ প্রতিশ্রুতি তার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমেরিকার প্রায় ১২ মাসের কৌশল যে ব্যর্থ, তারই প্রমাণ ধ্বংসস্তূপে রয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলকে গাজায় খাদ্য সরবরাহ, নিরাপদ অঞ্চল তৈরি, রাফাহ আক্রমণ, যুদ্ধবিরতির শর্ত এবং সর্বোপরি সংঘাত এড়াতে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে বলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তবে তা মানেনি ইসরায়েল।
এইভাবে প্রতিবার নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ মানার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনকে উপেক্ষা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে বিরক্ত ও হতাশ; তবে নেতানিয়াহুর কৌশল সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করলেও যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সন্নিকটে। এদিকে নেতানিয়াহু ইসরায়েলে অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন। অন্যদিকে কয়েকটি আরব দেশ নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে শোক করছে। এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কার্যকর কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি জিতছেন এবং পুরো জয়ের পথে রয়েছেন।
ঠিক এই মুহূর্তে ইরান যদি তার পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেকে ইসরায়েলের চেয়ে কঠোর প্রমাণ করতে না পারে, তবে নেতানিয়াহুই বেঁচে যাবেন, যিনি এখন চালকের আসনেই আছেন।