মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১০, অগাস্ট ২০২৪

নির্বাহী আদেশের সীমা কত দূর?

Share on:

বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২৬(১)-এ বলা হয়েছে- এই বিধানাবলীর সাথে অসামঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সে সকল আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে, (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সাথে অসমঞ্জস কোন আইন তৈরি করতে পারবে না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হলে তা এই ভাগের বিধানের সাথে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।


সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে- আইন অনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ করার কিংবা এর সদস্য হবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। এখানে যুক্তি সংগত বাধা বলতে সাধারণত সরকারি কর্মচারী বা অরাজনৈতিক সাংবিধানিক পদধারীদের জন্য প্রযোজ্য বা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত করা জন্য এটা কার্যকর করা হয়। তবে রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করতে জরুরি আইনে প্রযোজ্য হয়।

সংবিধানের এই ৩৮ অনুচ্ছেদের বিধানটা মূল সংবিধানের ছিল কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সরকারগুলো তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ১৪২ ধারার অযুহাতে নানা সংশোধনী করে সংবিধান ও নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে সংকুচিত করেছে। বিশেষ করে এই সরকার ২০০৯ ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৮ ও ৪৭ অনুচ্ছেদকে খন্ড-বিখন্ড করে তা নিজেদের মত করে তৈরি ও ব্যবহার করেছে।

দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটের মত ১৪ দলীয় জোটও একটি রাজনৈতিক প্লাট ফরম। এটা কোন সংবিধানিক কর্তৃপক্ষ নয়। তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারিত বিষয় কোন এখতিয়ার আছে কি? তারা তাদের সভায় কোন সিদ্ধান্ত নিলে এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাদের সভার কোন সিদ্ধান্ত কোন সংগঠনের ওপর কার্যকর হতে পারে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিষয় কোন অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার জন্য তাদের যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থন দানের সুযোগ না দিয়ে নির্বাহী আদেশে বাতিল করা সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। তাছাড়া সংবিধানের কোন মৌলিক অধিকারের কোনো ধারা অন্য কোনো অধ্যায় বা ধারা দ্বারা বারিত করা যায় না। এমনকি এই মৌলিক অধিকারের কোনো অনুচ্ছেদ যা মূল সংবিধানের সাথে ছিল কিন্তু পরে সংশোধিত অংশ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে অবশ্যই সংশোধিত অংশ অগ্রহনযোগ্য হবে। এখানে ২০১১ সালে ৩৮ ও ৪৭ অনুচ্ছেদের কিছু সংশোধনী বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলায় জামায়াত সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া আছে এটা সত্য কিন্তু পর্যবেক্ষণ কোন আদেশ নয় এটা ভবিষ্যৎ আইনকানুন বা বিধি তৈরির সময় সরকার বিবেচনায় নিতে পারে। নিতে বাধ্য নয়। তাহলে তো ষোড়শ সংশোধনী মামলার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার যে কান্ড ঘটাল, তা কিভাবে হলো? নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামী ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠা হয়ে ১৯৪৭ সালের পর জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। পরে ১৯৭৮ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পেলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কিছু বিধান যারি করলে জামায়াত সময়ের চাহিদা অনুসারে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে-এর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামে একটা সংগঠনের যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও বিভিন্ন মহলের ধারণা ওই মামলাগুলোতে নানা কৌশল করে জামায়াত নেতাদের শাস্তি দিয়েছে। এই ধারণা শুধু দেশ নয় বিদেশ মহলেও একই ভাবে বিদ্যমান। সেখানে মাছ ধরা ওয়ালোক না খুঁজে খালই ধরা ওয়ালাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তাছাড়া জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান-এর লোকবল এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে ১% চেয়ে কম হবে। শিবির তো ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা। তাদের কর্মীরা সব ১৯৯০ সালের পর জন্ম নেয়া। সুতরাং ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নিতে পারে না। এমন অবস্থায় এই নির্বাহী আদেশ গণতান্ত্রিক রীতির সাথে অসামঞ্জ্যস। সরকার কোটা ইস্যু নিয়ে বেগতিক অবস্থা সামাল দিতে তারা নানাভাবে আগুন নিয়ে খেলা করছে।

কোটা অন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত অভিযোগ বা প্রমাণও নেই। শুধুমাত্র ভিত্তিহীন অভিযোগে সংবিধানের ২৬, ২৭, ৩১, ৩২, মূল ৩৮ ও মূল ৪৭ অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে নির্বাহী আদেশের জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকারের এই হটকারি সিদ্ধান্তে বিএনপি, কল্যাণ পার্টি, লেবার পার্টি, বিভিন্ন ইসলামী দল ও সিপিবিসহ দীর্ঘদিনের বামপন্থীরাও সরকারের সমালোচনা করছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারের সমালোচনায় খোদ আওয়ামী লীগ অফিসে গত ৩১ জুলাই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে চরম অপমান করেছে। এক পর্যায়ে তিনি অফিসে থাকতে না পেরে বের হয়ে আসেতে বাধ্য হন।

নির্বাহী আদেশ সরকারের একটি জরুরি পদক্ষেপ। যেটা সরকার জনগণের কল্যাণে অপরের ক্ষতিসাধন না করে প্রয়োগ করতে পারেন। এই আদেশ দ্বারা কেউ ক্ষতি হলে সরকার তা করতে পারে না। যেমন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান, চাঁদ দেখা না দেখা, আবহাওয়া জনিত কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তর খোলা বা বন্ধ করতে পারা, যে কোন দুযোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেয়া ইত্যাদি । যেটার জন্য সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় হয় না। কিন্তু সংবিধানের ১৪২, সংশোধিত ৩৮ ও ৪৭ অনুচ্ছেদ দ্বারা ২৬, ২৭, ৩২ ও মূল ৩৮ অনুচ্ছেদ উপেক্ষা করতে পারে না। তাছাড়া অনুচ্ছেদ ২৬(২) অনুসারে রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোন আইন তৈরি করতে পারে না এবং করলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

সংবিধনের স্প্রীট এমন যে সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলে ক্রম অনুসারে তা গুরুত্ব পাবে। যেমন ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নিয়ে সমস্যা হলে অবশ্যই ১ বেশি গুরুত্ব পাবে। তারপর ২ তারপর ৩ এভাব ক্রম অনুসারে। অবশ্যই ১-এর সাথে ৭-এর গুরুত্ব তুলনাহীন। ১-এর অবস্থান বেশি বলেই তাকে প্রথমে রাখা হয়েছে। সরকারি দলের অনেকেই এ ধরনের কাজে তাদের সাথে একমত নন। ক্ষমতাসীন হলের সব এমপি যে এই মত সমর্থন করে তা কিন্তু নয়, তাই কেউ ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দল ও সরকারের শত্রু হতে চায় না। সরকারগুলো অনুচ্ছেদ ১৪২ এর দোহাই দিয়ে দেদারছে যা ইচ্ছা তাই প্রণয়ন করছে। ১৪২ অনুচ্ছেদ দিয়ে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত কোন কিছুতে হাতে দেয় যায় না।

যেহেতু সরকার জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে প্রমাণিত কোন অপরাধের তথ্য হাজির করতে পারে নাই। রাজনৈতিক প্রভাবিত সরকারি সংস্থার দেয় তথ্যের কোনো বিশ^াসযোগ্য হেতু থাকতে পারে না। ১৪ দল নামের একটি রাজনৈতিক প্লাট ফরমের সিদ্ধান্তে এভাবে নির্বাহী আদেশ হতে পারে না। তারা কোন সাংবিধানিক ও গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষ নন। তাছাড়া জোটের অন্যতম বড় শরিক জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলকে ঐ সভায় দেখা যায়নি। এজন্য এই সিদ্ধান্তকে বড় জোর ৫/৬টি সংগঠনের সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে, ১৪ দলের নয়।

এজন্য ঐ সভায় অনুপস্থিত দল সমূহকে এই সিদ্ধান্তের সাথে একতম একথা বলার যৌক্তি হেতু দেখা যায় না। এই আদেশের মাধ্যমে সরকার তার গঠনতান্ত্রিক ও নৈতিক সীমানা অতিক্রম করেছে। তাছাড়া গণভবন একটি সরকারি বাড়ি এখানে কোন রাজনৈতিক দল বা জোটের সভা করা কতটা বিধি সম্মত। সরকার দল, জোট ও সরকারি সম্পদ একাকার করে ফেলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বসে এক পক্ষ রাজনীতি করবে আর বিরোধীরা রাস্তায়ও সভা সমাবেশ বা মিছিলও করতে পারবে না, এটা কেমন গণতন্ত্র? এটাও কি নির্বাহী ক্ষমতাবলে?

দৈনিক সংগ্রাম