নিপীড়নের পথেই সরকার অগ্রসর হবে: অধ্যাপক আলী রীয়াজ
Share on:
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যে ‘আচরণ’ করা হচ্ছে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু কি হওয়ার কথা ছিলো? দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ভাড়া করা পেটোয়াদের হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা আগেও যে কোনও ধরণের বিক্ষোভের সময়ও ঘটেছে, প্রতিবার তা আগের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেয়ার পর সেখানে কিছু সিনিয়র শিক্ষক উপস্থিত হয়েছিলেন এই আশায় যে তাঁদের উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করবে। কিন্ত তার বদলে উপাচার্যের বাস ভবনের ফটক খুলে দেয়া হয়েছে আক্রমণকারীদের জন্যে। ওই প্রাঙ্গণেই শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছেন। এই খবর বেরিয়েছে, কিন্ত জানতে পারা যায়না তখন উপাচার্য কোথায় ছিলেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যে তাঁদের পদ প্রাপ্তি এবং রক্ষার জন্যে ছাত্রলীগের দ্বারস্থ হন তা জানা ছিলো, কিন্ত তাঁরা যে শিক্ষার্থীদের এবং নাগরিকদের দেয়া ট্যাক্সের পয়সায় তৈরি উপাচার্যের আবাসেই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারেননা সেটাই এখন সকলের সামনে হাজির হল। এটাও আসলে নতুন কিছু নয়। ঢাকায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পেটোয়া বাহিনীর সন্ত্রাসও নতুন নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের উর্ধতনদের জানিয়েছেন, এর বেশি কিছু করেননি। কিন্ত এগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অবস্থার ভয়াবহতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকদের নৈতিক অধঃপতনের মাত্রা।
এই নির্বিচার হামলার সূত্রপাতের সময় লক্ষ্য করুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে মন্তব্য করার পর, তাঁর দলের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ দেবার পর এই পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে। এর আগে পর্যন্ত মন্ত্রীরা আদালতের কথা বলছিলেন। আদালতে কোনও বিষয় বিচারাধীন থাকার সময় রাজপথে থাকা যাবে না এমন আইন কোথায়? বরঞ্চ এর বিপরীত উদাহরণ আছে। ২০১৩ সালে আছে; তার আগে - ২০০০ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার রাস্তায় মন্ত্রীদের নেতৃত্বে লাঠি মিছিল হয়েছিলো আদালতের বিরুদ্ধে।
কিন্ত আদালত আসলে বিষয় ছিলনা, ছিলো অপেক্ষা – নির্দেশের অপেক্ষা। সে নির্দেশ আসবার সাথে সাথেই কার্যকর হয়েছে। এই জন্যে আদালতের বিষয় যেমন অজুহাত তেমনি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শ্লোগান – তাঁরা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে দাবি করেছে। এই যে শিক্ষার্থীরা কি শ্লোগান দিলো, তাঁর অর্ধেক শুনে না শুনেই সেটা নিয়ে হামলে পড়া সেটা আসলে অনেক পুরনো কৌশল – ইংরেজিতে প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে “Give a dog a bad name and hang him”। শিক্ষার্থীরা যদি ‘আপত্তিকর’ শ্লোগান দিয়ে থাকে তবে তাঁর সমালোচনা করার, প্রতিবাদ করার অধিকার নিশ্চয়ই অন্যদের আছে, এ জন্যে অন্যরাও সভা-সমাবেশ করতে পারেন। কিন্ত তার জবাব দেবার জন্যে ছাত্রলীগ ‘প্রস্তত’ বলে ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যটি লক্ষ্যণীয় এবং তার আগেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক এবং সেখানে তাঁদের ‘নির্দেশ’ দেবার কথা গণমাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। তার পরের ঘটনাপ্রবাহ সকলের জানা।
আগামী কয়েক দিন ধরে এই হামলা-মামলা-ধরপাকড় অব্যাহত থাকবে এটা অনুমেয়। অন্যদিকে এই আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা লাভ করে কীনা তার ওপরেই নির্ভর করছে এই আন্দোলন কোন দিকে এগুবে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাহী বিভাগের পদক্ষেপের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি অবসানের আগ্রহ যে সরকারের নেই সেটা স্পষ্ট। উপরন্ত আরও বেশি নিপীড়নের পথেই সরকার অগ্রসর হবে, পেটোয়া বাহিনী এবং পুলিশই হচ্ছে সরকারের জবাব। এই আন্দোলনের শ্লোগানে এটাও দৃশ্যমান হচ্ছে, বিরাজমান শাসন ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা যে একব্যক্তির ক্ষমতা কেন্দ্রিক তা জোরেসোরেই বলা হচ্ছে। এই আন্দোলন আগামিতে যে পথেই অগ্রসর হোক না কেন আন্দোলনের এই দিকটি উপলব্ধি করা দরকার।