মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ২০, অগাস্ট ২০২৪

নদী সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়

Share on:

বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নদীর প্রতি কতটা আগ্রহী, দেড় দশক আগে লিখেছিলেন ‘নদী’ নামে আমার সম্পাদিত পানি ও প্রবাহ বিষয়ক বর্ষপত্রে।


‘শৈশবের নদী’ শিরোনামে ছোট্ট সেই স্মৃতিচারণে তাঁর গ্রামের বাড়ির পাশের খাল হয়ে হালদা ও কর্ণফুলী দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই খালে পৌঁছার বর্ণনা শেষে লিখেছিলেন– ‘আমরা অপেক্ষায় থাকতাম প্রতিবার, কখন দাদা শহরে যাবেন, সাম্পানে চড়ে। আর সুযোগ হবে আমাদেরও যাবার, নদী দেখার। নদী দেখার সেই আগ্রহ আমার এখনও কমেনি।’ (নদী/ প্রকাশক, রিভারাইন পিপল/ মুদ্রণ ও পরিবেশন, আদর্শ/ মার্চ ২০১১)।

এ বছর মার্চেও একাধিক মামলায় জেরবার অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। রেকর্ডিংয়ের আগে নানা বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে কৌতুক করে বলেছিলাম, বাংলাদেশে পত্রিকার প্রকৃত সার্কুলেশন এবং নদনদীর সংখ্যা জানা কঠিন। সরকারেরই একেক সংস্থা একেক হিসাব দিয়ে থাকে। তিনি হতাশকণ্ঠে বলেছিলেন– ‘দেখুন, গোড়ার কাজই কত বাকি!’

সেই মার্চের পর গত চার মাসে মরা বুড়িগঙ্গা দিয়েও অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তখনকার প্রবল প্রতাপান্বিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, খোদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তিনি নিজেই অনেক ‘গোড়ার কাজে’ হাত দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর্মসূচিতে নদী সুরক্ষার গোড়ার কাজগুলো থাকবে না?

কেবল মুহাম্মদ ইউনূস নন; বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে এমন কয়েকজন উপদেষ্টা রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে নদী, পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিষয়ে কাজ করে আসছেন। নদী সুরক্ষায় আন্দোলন, আলোচনা, গবেষণা, অ্যাডভোকেসি, লেখালেখির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন।

যেমন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের পিএইচডি গবেষণার বিষয়ই ছিল আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন ইস্যু। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের নদী সুরক্ষা আন্দোলনে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরিদা আখতার কেবল কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন; নদী বিষয়েও তাঁর প্রজ্ঞা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদের সঙ্গেও নদীবিষয়ক একাধিক দক্ষিণ এশীয় উদ্যোগে আমরা কাজ করছি। পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন যদিও মূলত কূটনীতিক; প্রাসঙ্গিকভাবেই আন্তঃসীমান্ত নদী বিশেষত তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র নিয়ে অনেক দিন ধরে কলাম লিখছেন ও টকশোতে অংশ নিচ্ছেন।

তার মানে, সরাসরি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত আইন, পানিসম্পদ, পরিবেশ, মৎস্যসম্পদ, পররাষ্ট্রের মতো মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে রয়েছেন উপযুক্ত ব্যক্তিরাই। নদীর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে। এই ‘নদীময় সরকার’ যদি নদী সুরক্ষায় গোড়ার কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারে, তাহলে আর কোন সরকার পারবে?

যদিও মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্পের মতোই, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদকে নদী সুরক্ষার অগ্রাধিকার তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের বিপুল কাজের ভিড়ে নদী সুরক্ষার বিষয়গুলো পিছিয়ে না যায়।

নদী বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে নতুন সরকারের জন্য নদী সুরক্ষায় পাঁচটি অগ্রাধিকার প্রস্তাব করছি। প্রসঙ্গত, আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতেই হবে। কারণ সেগুলোর প্রবাহই দেশের প্রায় সব নদীকে সচল রাখে। কিন্তু এখানে আমি কেবল অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারগুলোর কথা বলছি।

এক. নদী কমিশন সংস্কার

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশনায়। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, কমিশনটি হবে সরকারের সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগের নদীবিষয়ক কার্যক্রমের সমন্বয়ক এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে সেতুবন্ধ। হতাশাজনকভাবে, নদী কমিশন আইনেই গলদ রেখে এটা কার্যত পরিণত হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরে। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণেই কমিশনের ক্ষমতা শুধু সুপারিশমূলক; প্রায়োগিক নয়। প্রথম থেকেই চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক বা বর্তমান আমলাদের আধিক্য থাকায় কমিশন অঙ্কুরেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে গেছে। দেশে নদী সুরক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করতে হলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের মুক্তির বিকল্প দেখি না। এ বিষয়ে বারান্তরে আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল।

দুই. নদনদীর ডেটাবেজ

নদীমাতৃক বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ নদনদীই যে সবচেয়ে অবহেলিত, সেটা বোঝা যায় এই খাতে তথ্য-উপাত্তের দুরবস্থা দেখলে। যেখানে নদীবিষয়ক চৌকস ও স্বয়ংক্রিয় ডেটাবেজ দরকার ছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে দেশে কয়টি নদী আছে, কয়টি মরে গেছে, কয়টি মরমর– এই বিষয়েই গ্রহণযোগ্য ও চূড়ান্ত তালিকা পর্যন্ত নেই! এই কাজটিই এক অর্থে সর্বাগ্রে করতে হবে। যদি নদনদীর ভৌত চিত্রই স্পষ্ট না হয়, তাহলে কীসের পরিকল্পনা আর কীসের বাস্তবায়ন!

তিন. বিদ্যমান প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা

এমন নয় যে, নদী সুরক্ষার কাজে বিগত বছরগুলোতে অর্থ সংকট ছিল। যেমন নদীর নাব্য বাড়ানোর জন্য শুধু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ই ২০১৯ সালে ৫০ হাজার কোটি টাকা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। যেমন, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু বুড়িগঙ্গা সুরক্ষায়ই গত দুই দশকে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন’ হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, দেশের প্রায় সর্বত্র নদী খনন বা সুরক্ষা প্রকল্পগুলো কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থ পানিতে ফেলেনি; নদনদীর ক্ষতিই করেছে এবং নদীর জায়গা বেহাত হওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। বিদ্যমান প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা, অতীতের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের জবাবদিহির পাশাপাশি এমন প্রকল্প নিতে হবে, যেগুলোতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত হবে।

চার. দখল-দূষণে শূন্য সহিষ্ণুতা

দেশের নদীগুলোর দখল-দূষণ নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে; আইন, অভিযান, প্রকল্পও কম হয়নি। কিন্তু যত দিন গেছে, দেশে নদী হত্যার এই অপকর্ম বেড়েছে বৈ কমেনি। দখল উচ্ছেদ ও দূষণ বন্ধ করতে গিয়ে কেবল নগর-সংলগ্ন নদীগুলো যত মনোযোগ পেয়েছে, মফস্বলের নদীগুলো পেয়েছে ততটাই উপেক্ষা। সেই ফাঁকে এখন বোধ হয় দেশে এমন কোনো নদী পাওয়া যাবে না, যা দখল-দূষণের শিকার হয়নি। অনেক নদী যেমন দৈহিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; তেমনই দূষণের কারণে জৈবিকভাবেও মারা গেছে। অনেক নদীর জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও অর্থনেতিক উপযোগিতা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। দখল ও দূষণ নিয়ে তাই প্রয়োজন শূন্য সহিষ্ণুতা।

পাঁচ. নির্বিচার বালু উত্তোলন বন্ধ

আমার মতে, বাংলাদেশের নদীগুলোর জন্য একক বৃহত্তম বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে নির্বিচার বালু উত্তোলন। কিন্তু পেশাগত দক্ষতা ও উৎকর্ষ না দেখেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা বালুমহাল ইজারা পায়। বালুমহাল আইন ও বিধিমালায় নদীর ঢাল বা তলদেশ, জীববৈচিত্র্য, মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও আবাস, সড়ক বা সেতু নষ্ট না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যেখানে সেখানে ড্রেজার বসিয়ে যেভাবে খুশি বালু তোলা হচ্ছে। বালুমহাল হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তপনার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এই বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই নদীগুলোর অসুখ অর্ধেক সেরে যাবে।

উপসংহার

বলা বাহুল্য, নদী সুরক্ষায় নতুন সরকারের করণীয় তালিকা আরও দীর্ঘায়িত করা যাবে। যেমন– সুপেয় পানি বা সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির বদলে নদীর পানি ব্যবহার, সড়কপথের বদলে মালপত্র পরিবহনে নৌপথ ব্যবহার, নদীতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। স্থানাভাবে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু উপরোক্ত পাঁচটি অগ্রাধিকার আমলে নিলেই নদী সুরক্ষার কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

জানি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে টেবিলের এপাশ থেকে কথা বলা যত সহজ; মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে টেবিলের ওপাশে গিয়ে সেটার বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে কঠিন কাজও যে সহজ হয়ে যায়, সেটা কে না জানে!

দৈনিক সমকাল