নতুন সরকারের হাত ধরে দেশ ও অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসুক
Share on:
শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়, সরকারহীন হয়ে পড়ে।
এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণ হয়েছে। এ সরকারকে আমরা স্বাগত জানাই। নতুন সরকারের হাত ধরে দেশ ও অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসুক—এটিই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এক দুঃসময় অতিক্রম করছে। জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘটনার পরিক্রমায় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়; ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে বিরাজমান সংকটগুলো আরো প্রকট হয়েছে আন্দোলন ঘিরে। এমন ক্রান্তিকালে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নতুন সরকার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্বও এরই মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মোট ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বে থাকছেন। বলা বাহুল্য, পুরো দেশের হাল ধরতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে নতুন সরকারকে।
আওয়ামী সরকারের টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান সবই একপ্রকার তাদের কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। সীমাহীন দুর্নীতি ও একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েছিলেন দেশের কতিপয় ব্যক্তি। যার ফলে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনমন ঠেকানো যায়নি। দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের আগেই দেশে ফিরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা তার প্রথম কাজ বলে জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে সবার আগে প্রয়োজন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা। কেননা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনে চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হচ্ছে। হামলার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে বলে জানা গেছে। মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালকের মতেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নতুন করে যাতে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। তার মতে, এটিই হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলোর তদন্ত ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। অর্থাৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও জোর দেয়া প্রয়োজন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো না গেলে দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো দীর্ঘকাল ধরে নিম্নমুখী। ব্যাংক খাতের অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়—তারল্য সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, মন্দ ঋণ, ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের অনাস্থা। বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার। অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পাননি। এছাড়া অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক আমদানি-রফতানি, রাজস্ব আয়ের প্রকৃত চিত্রও নেই। জাতীয় পরিসংখ্যানে রয়েছে নানা ধরনের অসংগতি। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত করেছে। আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও পুরো দেশের অবস্থা আরো নগ্নভাবে জনসম্মুখে উপস্থাপন করেছে। বিশেষ করে পর্যাপ্ত ও আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে।
উপরন্তু সাম্প্রতিক অস্থিরতায় পোশাক খাতসহ বিভিন্ন কল-কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ও রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের বার্ষিক সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলারের রফতানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রফতানি থেকে। বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার বাংলাদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক ক্রয়াদেশ হারাতে হয়েছে। অর্থনীতির এসব ক্ষত সারাতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। এ সরকারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সফল গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মতো দলীয়করণের প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করতে এবং অর্থনীতির ক্ষত সারিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন এই আস্থা রাখি।
রাজনৈতিক দল যখনই সরকার গঠন করেছে, দেখা গেছে দলীয়করণ ও ব্যক্তিপূজার রাজনীতি ও অর্থনীতি। এর স্বরূপ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পরই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা পদত্যাগ করছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটেছে। আবার আওয়ামী চিকিৎসকরা হাসপাতালে যাচ্ছেন না বলে বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকে অনুপস্থিত থাকছেন। দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হতো তাহলে হয়তো ক্ষমতার পালাবদলের পর এমন গণহারে পদত্যাগের চিত্র আমাদের দেখতে হতো না। এমনকি পদত্যাগ করতে হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদেরও। শিক্ষাঙ্গন থেকে শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। নয়তো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নতি হবে না।
স্বৈরাচার শাসনের এসব বৈশিষ্ট্য দূর করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। দেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার পথে নতুন সরকার অগ্রসর হবে এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা চাই নাগরিক তার ভোটাধিকার ফিরে পাক। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দেশে স্বচ্ছ নির্বাচনের ধারা ফের চালু হোক। সরকারের জবাবদিহির সংস্কৃতি ফিরে আসুক। সর্বোপরি মানুষ মৌলিক অধিকার চর্চার সুযোগ পাবে—এটিই কামনা আমাদের।