মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ২৪, সেপ্টেম্বর ২০২৪

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য করণীয়

Share on:

বর্তমানে বাংলাদেশ একটা অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। প্রলম্বিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সারাদেশে পরিবর্তনের জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আগ্রহ, উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস অন্য যে কোনো পরিবর্তনের চেয়ে একেবারেই আলাদা।


জনগণ একটা ভিন্ন ধারার আকাঙ্ক্ষা লালন করছে, যার মূল কথা হলো তারা ‘ব্যবস্থা’র পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন ও গঠনে পরিবর্তন আনতে হলে সেটি একমাত্র নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়েই সম্ভব। আর রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের নতুন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা চুক্তি করতে গেলে একটা নতুন ধরনের সংবিধান দরকার। এই সংবিধান একদিকে যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করবে, একইভাবে সেখানে ২০২৪-এর নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা প্রতিফলিত হবে। সে জন্য সংবিধান সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করবে। সেই প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেছে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য সংবিধান সংস্কারের এ উদ্যোগ খুবই জরুরি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কমিশনের নাম দিয়েছে ‘সংবিধান সংস্কার’। সংস্কার ও সংশোধন যেমন এক জিনিস নয়, একইভাবে এর মানে বাতিলও বোঝায় না। সংস্কার মানে মধ্যবর্তী অবস্থান। জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বর্তমান সংবিধানের আওতায় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বর্তমানে যে সংবিধানটি প্রচলিত, তাতে নির্বাহী বিভাগ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ এ বিভাগকে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধীশ্বর করে রাখা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ভারসাম্য অপরিহার্য। বর্তমান সংবিধানে তিন বিভাগের মধ্যকার এ ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। এর বাইরে যেভাবে রাজনৈতিক মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে, তাতেও বড় ধরনের গণ্ডগোল রয়ে গেছে। এ কারণে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার মধ্যে সংশোধন করা দরকার। সংবিধান সংস্কার না হলে সেসব সংশোধনও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

কমিশনের প্রথম কাজ হলো নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। পুরোনো সংবিধান দিয়ে আমরা এগোতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে নতুন একটি সংবিধান লেখার প্রয়োজন পড়েছে। নতুন সংবিধান লিখে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সর্বস্তরে তার প্রতিফলন নিশ্চিত করার একাধিক পন্থা রয়েছে। এ সরকার প্রথমে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে সংবিধান খসড়া করবে। দ্বিতীয় ধাপে সর্বস্তরের মানুষ যথেষ্ট সময় নিয়ে খসড়াটি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখবেন। চূড়ান্ত ধাপে যে খসড়াটি তৈরি হবে সেটি গণভোটে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই গণভোটের আয়োজনের দায়িত্ব নেবে। গণভোটের মধ্য দিয়ে সংবিধানটি গৃহীত হলে নতুন সরকার সহজেই সেটি পরিবর্তন করার এখতিয়ার রাখবে না। কারণ, সরকার সংবিধানে পরিবর্তন আনতে গেলে তার জন্য যে আয়োজন দরকার, সেটাও নতুন সংবিধানে থাকতে হবে। বর্তমানে সংবিধান সংশোধনে যে সংসদীয় পদ্ধতি রয়েছে তাতে আমরা নতুন করে পরিবর্তন আনতে পারি। সে ক্ষেত্রে নিম্ন ও উচ্চ দুটো কক্ষের ব্যবস্থা রাখা যায়। উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট সায় দিলে সংশোধন আনা যাবে। এই প্রক্রিয়ায় সংশোধন করতে গেলে আবারও গণভোটের দরকার পড়বে। এতে যে কোনো সরকারের পক্ষে সংশোধন করা কিংবা সংবিধান বাতিলের বিষয়টি কঠিন হবে।

ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেছে। যেমন– বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৩১ দফার ঘোষণা দিয়েছে। দলটির নেতারা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চান। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের মানে এই নয় যে, তা পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতিটি একেবারেই অভিনব। সেটা বাংলাদেশের পক্ষে পুরোপুরি অনুকরণ করা সম্ভব হবে না, কিন্তু একটা প্রযোজ্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জাসদ (রব), জাতীয় পার্টির একটি অংশসহ আরও একাধিক দল, বামপন্থি রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছেন। এতে এটাই স্পষ্ট, জনগণের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করছে এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নয়।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দুটো জায়গায় পরিবর্তন আনা জরুরি। সেটা নিশ্চিত না করলে আমরা পুরোনো রাজনৈতিক ধারা তথা পরিবারতন্ত্রে আটকে থাকব। এরই মধ্যে দেশে জনআকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে– প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কিংবা এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন ব্যক্তি পরপর দু’বারের বেশি দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। এই পরিবর্তন করতে গেলেও আমাদের প্রথমে সংবিধানে সংস্কার আনতে হবে। শুধু এটা নিশ্চিত করলেই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। সেটা নিশ্চিত করতে আরপিও তথা রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার নির্দেশিকায় পরিবর্তন করতে হবে।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রধান অংশীদার হলো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের মধ্যে যিনি সভাপতি কিংবা নির্বাহী প্রধান হবেন, তিনিও পরপর দু্’বারের বেশি এই দায়িত্ব নিতে পারবেন না। যারা ইতোমধ্যে ১০-১২ বছর ধরে এ দায়িত্বে রয়ে গেছেন, তারা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। এগুলো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন লাভ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত। যদি এসব শর্ত নিয়ে আইনি কাঠামো দেওয়া যায় এবং নির্বাচন কমিশনও তা প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পরিবারতন্ত্রের খানিকটা উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে।

এখানে বলে রাখা দরকার, এসব আইনি কাঠামোর পরিবর্তন হলেই সামষ্টিক সুফল বয়ে আনবে, তা কিন্তু নয়। একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না ঘটলে এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই এ পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ভিন্নমতের চর্চা ও সমালোচনার ধারা তৈরি করতে পারলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দেখা দেবে। এ কারণে সংস্কার কেবল আইনি কাঠামোর বিষয় নয়, বরং একটা সাংস্কৃতিক বলয়ের সঙ্গেও যুক্ত। এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জনমনে একটা মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দেখা দেবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, প্রশ্নের উদ্রেক হবে, যা গণতন্ত্রের পথ শক্তিশালী করবে। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক হলে তা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে প্রভাব ফেলবে।

মোদ্দা কথা, নির্বাচনের আগেই আমাদের আইনি কাঠামোগুলোর পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে প্রথমেই আমাদের গণভোটের মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্গঠন ও রূপান্তর ঘটবে। এসব পরিবর্তন নিশ্চিত করা গেলে নতুন সংবিধানের অধীনে যে নির্বাচনটি হবে, তা জনগণ গ্রহণ করবে এবং গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এটা মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের পর জনগণের সঙ্গে কোনো রকম প্রতারণা করতে চাইলে ছাত্রসমাজ ও সচেতন নাগরিক তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার শক্তি রাখে।

দৈনিক সমকাল