মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ২৫, জুলাই ২০২৪

নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে

Share on:

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১ বছর। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নেই। বাবা-মা ও বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন, পাশবিকতার কথা শুনেছি। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, সেতু ধ্বংসের কথা শুনেছি।


পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও অন্যান্য বক্তৃতার রেকর্ড শুনেছি। বই-পুস্তক পড়ে উপলব্ধি করেছি কীভাবে লাল-সবুজ পতাকা ও স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।

নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রত্যক্ষ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও লাশের রাজনীতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমার শিক্ষাজীবন দুই-আড়াই বছর পিছিয়ে যায়। আরও অনেকের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হয়েছে। কারও কারও সরকারি চাকরিতে যোগদানের নির্ধারিত বয়স চলে গেছে।

পরবর্তী সময়ে আরও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছি; বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ২০০৭-০৮ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারবিরোধী আন্দোলন।

২০১৮ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও দেখেছি। কিন্তু কোটা সংস্কার নিয়ে গত এক সপ্তাহে যে আন্দোলন দেখলাম, এর সঙ্গে আমার দেখা গত চার দশকের কোনো আন্দোলনের মিল নেই। কোনো একটি অরাজনৈতিক দাবিতে এত ধংসযজ্ঞ চলতে পারে, স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন!

এ ছাড়া ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। একদিকে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ, অন্যদিকে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলাম– দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল দেশব্যাপী জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন। কোনো আন্দোলনের তীব্রতাই সম্ভবত গত সপ্তাহের সহিংসতার সঙ্গে তুলনীয় হবে না।

এটা ঠিক, অরাজনৈতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তি যুক্ত হলে এর তীব্রতা বাড়তে পারে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটও গত এক দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছে। ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু এত ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাণহানি কি তখন ঘটেছিল?

দেশের আইকনিক উন্নয়ন স্থাপনা মেট্রোরেল, সেতু ভবন, এক্সপ্রেসওয়েতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নথিপত্র ধ্বংসের মতো কার্যকলাপ আগে কখনও দেখিনি। এই আন্দোলনে যত নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে, সেটাও আমার ধারণা একটি রেকর্ড। এত অবকাঠামো ও যানবাহন জ্বালাও-পোড়াও স্বাধীনতার পরে কখনও দেখা যায়নি।

সরকারের এত এত গোয়েন্দা বিভাগ থাকা সত্ত্বেও বিরোধী গোষ্ঠী হঠাৎ দু-এক দিনে এত শক্তি দিয়ে কীভাবে এমন তাণ্ডবলীলা চালাল? জেলখানায় ঢুকে ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও বহু আসামি বের করে নিল; অস্ত্র লুট করল? এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সক্ষমতার বিষয়টি কি কথার কথা?

আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপেশাদারি কার্যকলাপও দায়ী। বিশেষত রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে যেভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আর সরকারবিরোধী গোষ্ঠী উত্তপ্ত পরিবেশকে নিজেদের কাজে তো লাগাতেই চাইবে!

প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনটির পাল্স্ আওয়ামী লীগ প্রথমেই বুঝল না কেন? দলটি টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায়। এই দল কেবল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বই দেয়নি; স্বাধীনতার আগে ও পরে অনেক আন্দোলন করেছে ও মোকাবিলাও করেছে। দলটির রয়েছেন বহু চড়াই-উতরাইয়ের অভিজ্ঞতা এবং অনেক বর্ষীয়ান নেতা। তার পরও প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই দল একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন শুরুতেই মোকাবিলা করতে পারল না কেন? আওয়ামী লীগ কি নতুন প্রজন্মের পাল্স্ বুঝতে পারেনি?

স্বীকার করি, বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর প্রজন্ম আর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রজন্ম অভিন্ন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা যা দেখে বড় হয়েছি, এই প্রজন্ম তার অনেক কিছুই দেখে বড় হয়নি। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি বলে পরিচিত। তরুণ প্রজন্মের অনেকে মাছ-ভাত পছন্দই করে না। আমাদের দেশপ্রেম জন্মেছে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায়। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শ দেশ মানে কর্মসংস্থান, স্বাধীন চলাফেরা ও মতপ্রকাশ, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা এবং ঝঞ্ঝাটবিহীন জীবন। প্রজন্মের এই বদল অস্বাভাবিক নয়; বরং যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে নতুন প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়াকে সম্মান করতে হবে। তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সব সরকারেরই সংবেদনশীল হওয়া জরুরি।

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সন্ত্রাস নির্মূলে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ও দুর্নীতি বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকে জনগণের পাশে থেকে দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী সরকার ইতোমধ্যে পরিপত্র প্রকাশের মাধ্যমে কোটা সংস্কার সমস্যার সমাধান দিয়েছে। আশা করি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাস্তবায়নযোগ্য দাবিগুলোও শিগগির পূরণ করা হবে। একই সঙ্গে নিরাপদ সহাবস্থানের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাক্তন ভিজিটিং প্রফেসর, এমআইটি, যুক্তরাষ্ট্র

দৈনিক সমকাল