ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর জাতীয় ঐক্য এনে দিয়েছে গণ-অভ্যুত্থান
Share on:
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ তার দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময়ের পথপরিক্রমায় এমন অভূতপূর্ব সময় আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পালাবদল, সরকার পতনের আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন, বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে মিটিং–মিছিল, রাজনৈতিক হত্যা—এসবের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
শুধু তা–ই নয়, আমরা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছি ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থান ও তার পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ঘটে গেছে যে অনেকেই এত কিছু একসঙ্গে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুব দ্রুততার সঙ্গে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সবার অলক্ষ্যে দেশত্যাগের মতো ঘটনার সঙ্গে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছে এ দেশের মানুষ।
এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংগত কারণেই এক অস্থিতিশীল সময় পার করছি আমরা। আমাদের খুব দ্রুত বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক আচরণে। এমনকি তা প্রভাবিত করছে আমাদের পেশাগত জীবন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আচরণকে।
অস্থিতিশীল এই সময়ে মানসিকভাবে ভালো নেই অনেকেই। আন্দোলনের দিনগুলোতে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, বিভিন্ন সহিংসতা আর বীভৎসতার শিকার হয়েছেন কিংবা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে এমনিতেই অনেক সময় লাগবে।
তার ওপর আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তার অভাব, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও লুটতরাজ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা, লাগামহীন দুর্নীতি উন্মোচনের খবর, চরম প্রভাবশালীদের নিদারুণ পরিণতি দেখার মনস্তাত্ত্বিক চাপ, পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে নানান মত ও পথের ভিন্নতার সাক্ষী হওয়া—এর সবকিছুর প্রভাব একযোগে পড়ছে ব্যক্তির ওপর।
সাধারণত পরিবর্তনের এই সময়গুলো হয় খুব ভয়ংকর। এই সময়গুলোতে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে না পারলে গণ-আন্দোলনের ফল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
প্রতিদিনই আমরা মুখোমুখি হচ্ছি মন খারাপ করার মতো অনেক কিছুর সঙ্গে। একদিকে বিগত সরকারের পর্বতসমান লুটপাট আর দুর্নীতির নতুন নতুন খবর আর অন্যদিকে দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, সুবিধাবাদী শ্রেণির আবির্ভাব নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলছে আমাদের।
বিগত সরকারের দুর্নীতির চালচিত্র এত দিন আমাদের অজানা ছিল, তা বলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্নীতি আর লুটপাটের বাস্তবরূপ যে কতটা বীভৎস আর ভয়ংকর হতে পারে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা ছিল।
এত দিন রেখেঢেকে রাখা দুর্নীতির খবরগুলো একযোগে বেরিয়ে আসছে জোয়ারের পানির মতো। লুটপাটে অর্জিত আর পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ টাকার অঙ্কে এতটাই বড় যে তা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি আছে গুম, হত্যা, অরাজকতা, স্বজনপ্রীতি, সহিংসতার নানা ইতিহাস উন্মোচনের খবর। যাদের আমরা এত দিন দোর্দণ্ড ক্ষমতাশালী হিসেবে দেখেছি, তাদেরই আজ প্রকাশ্যে ধরাশায়ী হতে দেখে কেউ কেউ বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়ছেন আবার কেউবা একধরনের পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করেছেন।
প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের খবর দেখতে দেখতে আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এই বাড়তি চাপ নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি অনেকেরই নেই। ফলে অনেকের অসংলগ্ন, অসহিষ্ণু ও অপরিণত আচরণের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
এবার আসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানেও আছে আসল-নকল আর সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব। আন্দোলন–পরবর্তী ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের হঠাৎ সীমাহীন স্বাধীনতা কলুষিত করে ফেলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
আমরা মাত্রাজ্ঞান শূন্যের মতো যা খুশি তাই পোস্ট দিচ্ছি, কনটেন্ট কিংবা আধেয় শেয়ার করছি, মন্তব্য করছি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে কিনা জানি না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভীষণ অপরিণত, অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক আচরণের পরিচয় দিচ্ছি আমরা।
আমরা কিছুতেই অন্যের মতামত সহ্য করতে কিংবা অন্যের মন্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারছি না। ফলে তা প্রভাব ফেলছে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়াল ছাপিয়ে আমরা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছি।
সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হলেও এখনো সেখানে আসেনি স্থিতিশীলতা। থানাগুলোতে এখনো পুলিশ সেভাবে তৎপর হয়নি, রাস্তার ট্র্যাফিক পুলিশ এখনো পূর্ণ মাত্রায় সক্রিয় হয়নি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গেলেও থমথমে ভাব এখনো কাটেনি।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। সরকারি চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার দাবি নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা রাস্তায় নেমেছেন, ৬০ হাজার ভুয়া সার্টিফিকেটধারী শিক্ষকের অস্তিত্ব মিলেছে, আনসার বিদ্রোহের চেষ্টা হয়েছে।
জাতীয় সংগীত কিংবা জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করার মতো বিতর্কিত দাবিও উঠেছে। প্রতিদিনই যেন দাবি আদায়ের নতুন নতুন পটভূমি রচিত হচ্ছে। প্রতিটি দিন যেন এখনো নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দেখার অপেক্ষা।
পরিবর্তনের এই সময়ে প্রয়োজন প্রচুর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর পরিণত আচরণ। আমাদের অসতর্ক ও অসহিষ্ণু আচরণের ফাঁক গলে সুযোগসন্ধানীরা এরই মধ্যে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে।
সেই সুযোগসন্ধানীদের যেকোনো প্রকারে থামাতে হবে। একমাত্র জাতীয় ঐক্যই পারে সেই চেষ্টাকে রুখে দিতে। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করলে আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ব এবং আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে কখনোই পৌঁছাতে পারব না।
তাই আসুন, আমরা পরিমিত ও পরিণত আচরণ করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র দায়িত্বশীল আচরণ করি। যেকোনো কিছু প্রচার ও প্রসার করার আগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করি, উসকানিমূলক মন্তব্য পরিহার করি কিংবা এড়িয়ে যাই।
মনে রাখতে হবে, আজকের এই নতুন বাংলাদেশ রচনার গৌরব কিন্তু আমাদের সকলের। আমাদের সামান্য অসতর্ক আচরণে তা যেন ম্লান না হয়ে যায়। ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণে হাজারো দাবি না তুলে আসুন আমরা রাষ্ট্র ও পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে অটুট থাকি।
একমাত্র রাষ্ট্রের সঠিক সংস্কারই পারে ব্যক্তির স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে।