মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ২১, অগাস্ট ২০২৪

দেড় দশক ধরে নিপীড়িতরা রাজপথে নামতে শুরু করেছে

Share on:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই সপ্তাহ পার না হতেই রাজধানী যেন বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়েছে! কয়েক দিন ধরে সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় বাসভবনের সামনে, সায়েদাবাদ মোড়, প্রেস ক্লাবের সামনে অন্তত ডজনখানেক সংগঠন, পেশাজীবী শ্রেণি ও নাগরিক সমাজ বিভিন্ন দাবি নিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করছে।


এতে শহরজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় এবং নগরবাসী ভোগান্তিতে পড়ে। আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল চাকরি স্থায়ীকরণ, সংস্কার ও জাতীয়করণ, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পুনর্তদন্ত, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল ইত্যাদি।

ভোটাধিকার হারানো মানুষ অন্তত দেড় দশক ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বাক্‌স্বাধীনতার সংকুচিত পরিসর ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দেখে আসছে। হঠাৎ দেশের আমূল পরিবর্তন তাদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে। আন্দোলনকারী অনেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে গিয়েও বিক্ষোভ করছেন। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নতুন করে ঘটনার তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, আদিবাসীদের পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে ‘সমতলের আদিবাসী ছাত্র-যুব ও সাধারণ জনগণ’। মাদ্রাসা বোর্ডে বৈষম্য রোধের দাবিতে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি এবং পুলিশ সদস্যদের মতো রেশন ও পেনশন সুবিধার দাবিতে মানববন্ধন করেছে গ্রাম পুলিশ। এইচএসসির বাকি পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রবেশ করে। অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বিক্ষোভ ও সমাবেশে কোথাও কোনো ধরনের পুলিশি হয়রানির ঘটনা ঘটেনি। এর মানে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পরিসর বেড়েছে। নিঃসন্দেহে এটি সর্বস্তরের মানুষের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে।

দাবিদাওয়ার পক্ষে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করা জনগণের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র কোনোভাবে জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। সুন্দর ও নিরাপদ জীবন লাভের পক্ষে যে কোনো নাগরিক দাবি জানাতে পারে। গত কয়েক দশক বাংলাদেশের জনগণ এই অধিকার পুরোপুরিভাবে চর্চা করতে পারেনি। বিশেষত পুলিশি হয়রানির কারণে মানবাধিকার ভয়াবহভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় আমরা মনে করি, সরকারের উচিত এসব দাবি গুরুত্ব সহকারে শোনা। একইভাবে আন্দোলনকারীদের উচিত সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে সরকারের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজটি যে কোনো সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে সরকারের ওপর বহুবিধ দায়িত্ব বেড়েই চলেছে। নাগরিক সমাজের অনেকেই সংবিধানের মতো মৌলিক জায়গায় পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন দিতে চাপ দিচ্ছে, যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ এখনও নির্ধারিত হয়নি। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। দুদক ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে শত শত মামলার তদন্ত শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েক দিনের বিক্ষোভ ও সমাবেশ সরকারের ওপর নতুন করে চাপ ও চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে।

সরকার যদি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার, বিভিন্ন সংগঠন, পেশাজীবী শ্রেণি ও গোষ্ঠীর দাবিগুলোর সুষ্ঠু সমাধান দিতে না পারে, তাহলে জনঅসন্তোষ বাড়তেই থাকবে। তবে মানুষেরও উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করা। এ সরকারের কিছু অগ্রাধিকার আছে, সেদিকে যদি তারা মনোযোগ দিতে না পারে তাতে সংকট আরও বাড়বে। তা ছাড়া তাদের সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি বিবেচনায় না নিয়ে সবাই যদি যার যার মতো দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, তাতে রাজধানীবাসীর ভোগান্তিও বাড়তে থাকবে। তা ছাড়া দাবি আদায়েরও তো কিছু নিয়ম আছে। বিভাগীয় পর্যায়ে দাবি পেশ করে বা বিবৃতি দিয়ে কিংবা কয়েকজন প্রতিনিধির মাধ্যমে চেষ্টা-তদবির করে না হলে রাস্তায় নামার বিষয়টি সব শেষে থাকতে পারে।

দৈনিক সমকাল