শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ৬, অগাস্ট ২০২৪

দেশ রক্ষায় সামনে আমাদের যেসব চ্যালেঞ্জ

Share on:

গোটা দেশ দেখল মৃত্যুর মিছিল। প্রতিটি হত্যায় মানবিকতার পরাজয় ঘটে। সেটাই ঘটতে দেখলাম আমরা। এ বিপদসংকুল পথ কারও কাম্য হতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে বিভাজন নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়নি দেশকে। পারস্পরিক সমঝোতাবোধ লোপ পেয়ে গিয়েছিল।


শক্তির উন্মত্ত প্রকাশ ছোটই করছে। দ্বিধাহীনতা, উসকানি, বল প্রয়োগ কোনো সমাধান নয়। হত্যা, জাতির ক্ষয়, রাষ্ট্রের ক্ষতি। পাশবিকতা মানুষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। স্বল্পমেয়াদে নিজেকে জয়ী ভাবার প্রবণতা দীর্ঘ মেয়াদে পরাজয়ের শামিল। সেটি আবারও প্রতীয়মান হলো।

বর্তমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কাজ করছে না, সেটিই আমরা দেখে আসছি। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নাই। বৈধতাহীনতার সংকটে জরাগ্রস্ত হয়ে গেল সরকার।

জনগণের কাছে জবাবদিহির দায় না থাকায় রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ‘মানি মেকার’ এবং ‘রুল মেকার’ যোগসাজশে একচেটিয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বন্দোবস্ত তৈরি হয় একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের (সংসদ, নির্বাহী ও বিচার) মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকায় ক্ষমতার পৃথক্‌করণের অনুপস্থিতি দেখা গেল। সকল ক্ষমতা হয়ে গেল এক ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছাধীন থাকল না।

জনগণের সার্বভৌমত্ব না থাকলে নাগরিক অধিকার নিশ্চিতি দুরূহ। সংবিধানে দলের বাইরে গিয়ে কারও ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়—জাতীয় বাজেট: কার জন্য, কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয়? জনগণের অর্থের নজরদারি ও জবাবদিহি কীভাবে হবে?

এমনি নানা প্রশ্নে বিদ্ধ এই সংবিধান। একের পর এক সংশোধনীর মাধ্যমে কাটাছেঁড়া করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। ‘জনগণের উইল’ অথবা রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) নাই।

তৃতীয়ত, আরেক বড় ব্যাধি—বাংলাদেশে কখনো কোনো রাজনৈতিক দল আরেক রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। এক দলের শাসনের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সামাজিক চুক্তির ভঙ্গুর দশা সরকারকে নাগরিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।

বর্তমান গণ-আন্দোলন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকেনি; এই গণজাগরণ উক্ত তিন ব্যাধি থেকে মুক্তির ‘সামাজিক সম্মতি’। আপামর জনতা ন্যায় দাবিতে সব সময়ই নিজেকে যুক্ত করেছে। তাঁরা দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে নারাজ। দ্বন্দ্বের মীমাংসা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে; নতুন সামাজিক চুক্তিতে অর্থাৎ নতুন সংবিধানে। এই চাওয়া মুক্তিযুদ্ধের মৌল ভিত্তি তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারেও প্রোথিত।

জাতি-রাষ্ট্রকে জনগণ বারবার পরিবর্তিত করেছে। যেমন, ফরাসি দেশে পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ‘আর্টিকেলস অব কনফেডারেশন’ তরুণ জাতির চাহিদা পূরণে অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় ১৭৮৭ সালের ফিলাডেলফিয়া কনভেনশন নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত বলবৎ থাকা জাতীয় সংবিধান।

স্মর্তব্য যে, প্রাথমিকভাবে কনভেনশনের ম্যান্ডেট কনফেডারেশনের আর্টিকেলসগুলো সংশোধন করার হলেও ভার্জিনিয়া প্ল্যান, নিউ জার্সি প্ল্যান এবং তারপর ‘কানেকটিকাট সমঝোতা’ তথা সংবিধান গৃহীত হয়।

এ কথাও সবার জানা, আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন, জন জে এবং জেমস ম্যাডিসন ‘পাবলিয়াস’ নামে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ৮৫টি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ সংবিধান রচনার মূল হচ্ছে জন তর্ক-বিতর্ক। নতুন সংবিধান প্রণয়নে ‘গ্রহণযোগ্য জাতীয় সরকার’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কনভেনশন বা সংবিধান সভা বা উভয়ই গ্রহণ করতে পারেন। প্রক্রিয়া নিয়ে আরও তর্ক-বিতর্ক হতে পারে।

গ্রহণযোগ্য জাতীয় সরকার ব্যবস্থার নজির বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। জরুরি পরিস্থিতিতে একটি রাষ্ট্র বৈধভাবে এমনভাবে কাজ করতে পারে যা সাধারণত সংবিধান অনুযায়ী না হলেও আইনসম্মত হবে।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নজির (প্রিসিডেন্ট) আছে। কনভেনশন সামাজিক নিয়ম, একটি অলিখিত বোঝাপড়া; সর্বজনীনভাবে পালন করা হয়। উদ্ভূত একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধানের জন্যই একটি নতুন কনভেনশনে সম্মত হয়।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তে অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে অর্থনীতিতে একচেটিয়াবাদ ও রাজনীতিতে গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেখানেই টেকসই হয়, যেখানে জবাবদিহি এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।

২.

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো থেকে বেরিয়ে আসার পথ আছে। এখানে হতাশার জায়গা নেই। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সমাধানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিবেশের পরিবর্তন ছাড়া এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ স্ট্যাটাস ক্যু বা স্থিতাবস্থার খাদে পড়ে গেছে। গোষ্ঠীতন্ত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপে সৃজনশীল উপায়ে সমাধানের রাস্তায় যেতে পারছে না।

একটি দেশের উন্নয়ননীতির মৌলিক নীতিগুলো সংশ্লিষ্ট দেশটির জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জন-আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত হয়। সেদিক থেকে বলা যায়, কোনো একটি দেশের মানুষ যে ধরনের সমাজে বাস করতে চায়, তাকে বোঝা ও মেনে নেওয়াই হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ননীতি।

এই সামাজিক রূপান্তর অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। তাই এসপিরেশন বা আকাঙ্ক্ষা ও ইম্পোজিশন বা আরোপণ-পরস্পরবিরোধী এই দুটি সত্তার মধ্যে আজন্মের দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

অর্থনীতি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব সূচকের অবনতিই তার সাক্ষ্য। দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতির সঙ্গে প্রকৃত মজুরির ফারাক বেড়েই চলছে। দাম বাড়ার কশাঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচের পরিবার শুধু নয়, নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষও পর্যুদস্ত।

বৈষম্যের জাঁতাকলে অধিকাংশ মানুষ জর্জরিত। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত জনতার কর্মসংস্থানে, আয় ও সঞ্চয়ে বড় ধরনের আঘাত পড়েছে। যুবকদের জনশক্তিতে রূপান্তর না করে অনিশ্চিত যাত্রায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সমাজের মাঝখানের শ্রেণিগুলোতে ভাঙন ধরেছে।

একইভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোও মূল্যবৃদ্ধিতে আক্রান্ত। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও তার সুফল কৃষক পান না, পায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকের দিন আনি দিন খাই বা ঋণ করেই যাপিত জীবন। ঘরে ঘরে নগদ টাকায় টান পড়েছে। ঋণে জর্জরিত সরকারেরও অর্থাভাব প্রকট। আয় কম বলে পাওনা পরিশোধে হিমশিম অবস্থা।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও সরবরাহ কম ও ডলারের বিপরীতে টাকার মানের টানা পতন অর্থনীতিতে গভীর নিম্নচাপের জন্ম দিয়েছে। আইএমএফের বেলআউট প্যাকেজের আওতায় অর্থনীতি আইসিইউতে আছে। আইএমএফ অনেক শর্ত দিলেও রোগের মূল তথা বখরা-বণ্টনকারী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিরসনে কোনো ওষুধ দেয়নি।

এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’ নিয়ে নীরব; বরং বিশ্বের বিভিন্ন ঋণমান পূর্বাভাসকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ঋণমান নামিয়েই যাচ্ছে। দৃশ্যমান হাত-ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব-কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ কাজ করতে পারছে না।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তে অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে অর্থনীতিতে একচেটিয়াবাদ ও রাজনীতিতে গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেখানেই টেকসই হয়, যেখানে জবাবদিহি এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।

অন্যদিকে গোষ্ঠীতন্ত্র যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব কটি নির্দেশকই বিপরীতমুখী হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। এখানে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে, ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে; কর্মসংস্থানহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছেই, প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগকেন্দ্রিক হয়নি, পরিবেশের ক্ষেত্রে দখল-দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক হোক অথবা অনানুষ্ঠানিক হোক—প্রতিষ্ঠান যদি কাজ না করে, তাহলে উল্টো ফলটাই আসবে। এর ফলে বৈষম্য আরো বেড়েছে। কর্তৃত্ববাদ সত্তা একটি অন্যায্য সমাজ তৈরির দিকে ধাবিত করছে।

নিষ্কাষণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রসার ঘটার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক প্রতিনিধিত্বসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিসর সংকীর্ণ হওয়ায় অর্থনৈতিক রূপান্তর বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতির পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন সুদূর পরাহত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সম্পর্কে একটি মিথীয় ধারণার কথা বলে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে একটিতে আপস করার কোনো দাবি তাত্ত্বিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং তা’ প্রমাণে কোনো তথ্য ও উপাত্ত নাই। বরং সেখানে পাবলিক অর্ডার আছে।

কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অর্থনীতি নিশ্বাস নিয়ে গতিপ্রাপ্ত হবে না। কাঠামোগত সংস্কারের অন্তত পাঁচটি স্তম্ভ থাকতে হবে—আস্থা (কনফিডেন্স), পুনরুদ্ধার (রিকভারি), পুনর্গঠন (রিকনস্ট্রাকশন), সংরক্ষণ (সোশ্যাল প্রোটেকশন) এবং টেকসই (সাসটেইনেবিলিটি) কাঠামোগত সংস্কার না হলে পুঁজিবাজার ও ঋণব্যবস্থা কাজ করবে না। আয়কর, এফডিআই বা সঞ্চয় বাড়বে না। এখানে আলোচনা হচ্ছে সুদহার বা মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে।

এই কেতাবি অনুমিতি শুধুমাত্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রযোজ্য। বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে কাজ হয়নি; বরং জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বাজারও প্রতিষ্ঠান। ধনবান ও নীতিপ্রণেতারা একাকার হয়ে গেলে গোষ্ঠীতান্ত্রিক বাজার তৈরি হয়। এই বাজার ভোক্তাদের ওপর অধিকতর জবরদস্তিই চাপিয়ে দেয়। রেগুলেটরি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারই বাজারকে আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে।

সর্বজন সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পূর্ণাঙ্গ জীবন-চক্র ভিত্তিক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনরুদ্ধার কর্মসূচির মৌলিক স্তম্ভ।

পূর্ণাঙ্গ জীবন-চক্র ভিত্তিক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা তথা সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয় সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা সামাজিক সংরক্ষণে প্রয়োজনীয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিশিল্পায়ন ঠেকানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পুনর্গঠনের মধ্যমেয়াদি কৌশল।

বর্তমানের ভোগ ব্যয়কেন্দ্রিক জিডিপি বৃদ্ধির মডেল থেকে বেরিয়ে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকেন্দ্রিক টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত অগ্রযাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা।

তথ্য বা উপাত্ত বানানো গল্প হতে পারে না। রপ্তানির তথ্য ঠিক করা হয়েছে। আমদানি, কর বা রেমিট্যান্স তথ্য এখনো সঠিক নয়। যেখানে প্রকৃত নম্বর পাওয়া যায়, সেখানেই সঠিক সংখ্যা নাই, তাহলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি কত? জিডিপি’র প্রাক্কলিত হয়। বিরাট অংশ আসে জরিপ বা অন্য উৎস থেকে। অপতথ্য ও ভুল তথ্যে পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে। তথ্য-পরিসংখ্যানের আমূল সংস্কার অতীব জরুরি।

বখরা-বণ্টনকারী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত রাষ্ট্র চালালে দায়বদ্ধতা থাকে না। নাগরিকদের কল্যাণ জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জনকল্যাণ মূলত ‘পাবলিক সোসাইটি’র ওপর নির্ভরশীল। আর ক্ষমতার সুষম বণ্টনের মধ্য থেকেই অধিকাংশের পাবলিক সোসাইটির উত্থান ঘটে।

৩.

একটি দেশ কখনোই বহিস্থ চাপ সামলাতে পারে না, যখন পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর স্বজনতোষী রাজনীতি ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে অধিকাংশ জনগণকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীন মহলের সুবিধা আদায়ের প্রবণতায় জরাগ্রস্ত হয়ে থাকে।

ভারসাম্য রাখার একটা বয়ান বা ন্যারেটিভ চালু আছে। এটিকে ‘জিরো সাম গেমে’র তাত্ত্বিকতায় বা বহুপাক্ষিকতার দোহাইয়ের আবর্তেও ঘুরপাক খাওয়ানো হয়। ভারসাম্য রক্ষার নামে বাংলাদেশ বিশেষ কোনো দিকে ঝুঁকে পড়লে এই ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা কাজ করে না।

বিকাশমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা জটিলতার মধ্যে দিয়ে চলছে। উন্নয়নবিষয়ক আলোচনার পরিসরে ভূরাজনীতি এবং ভূ-অর্থনীতির সঙ্গে জানা এবং অজানার যোগসূত্র রয়েছে। এই চেনা-অজানার বিপত্তি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিও তৈরি করছে। জটিলতাগুলোকে লাগসইভাবে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক কৌশল অবলম্বন জরুরি।

বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত। চীনের দক্ষিণ ভূমিবেষ্টিত অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনেরও উৎস। এই উপসাগর বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের আঁধারও বটে।

বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত; দক্ষিণ-পূর্বের কিয়দংশে মিয়ানমার। সেই অর্থে বাংলাদেশ আসিয়ান ও চীনেরও প্রতিবেশী। পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মৌসুমি-বায়ুর-বাংলাদেশ একটি সভ্যতা- বিধৌত রাষ্ট্র। বাংলাদেশের ঝুঁকে পড়ার বা ভারসাম্য রক্ষার দরকার নাই। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

৪.

বাংলাদেশ তার নিজস্ব পদ্ধতিতেই সমাধান খুঁজে বের করেছে এবং করবে। ১৯৯১-০৬ ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে ত্রুটিযুক্ত গণতান্ত্রিক নিরীক্ষা হয়েছিল। ওই মেয়াদকালে অর্থনীতির প্রতিটি ধনাত্মক (বা ঋণাত্মক) চলকেই ত্বরণ ছিল। পরবর্তী সময়ে বাড়ার বা কমার গতি কমেছে।

পুরোনো তত্ত্বে গোঁড়ামি থাকায় তা ভেঙে যাচ্ছে। আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য এখন উন্নয়নের নতুন তত্ত্ব এবং সহযোগিতার নতুন রূপ-কাঠামো প্রয়োজন। মানব জাতি ও এই গ্রহের জন্য একটি সবুজ, নিরাপদ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে জাতিগুলোর অভ্যন্তরে ও পরস্পরের মধ্যেও একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রয়োজন।

স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্য-নাগরিকের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা। অধিকার আকাঙ্ক্ষী বাংলাদেশ সংবিধান সভার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিভাজন, তিন বিভাগের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব উপহার দিতে পারে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বাধা অতিক্রমের নতুন সৃজনশীল কায়দা যুগে যুগে বের হয়েছে।

প্রথম আলো