দেশের বিষাক্ত পুঁজ বেরিয়ে গেছে
Share on:
শেখ হাসিনা অবশেষে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের মুখে গদি আঁকড়ে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ক্ষমতার বেপরোয়া প্রয়োগ করেছেন তিনি। নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে নির্মম নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তবু শেষ রক্ষা হয়নি।
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে, খুনি হাসিনার বুলেটের সামনে অকাতরে বুক পেতে দিয়েছে এ দেশের বীর তরুণরা। অসংখ্য মৃত্যু ও রক্তের পথ বেয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা সিন্দাবাদের ভূতকে গত ৫ আগস্ট ছুড়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শাহাদাতের অমিয় পেয়ালায় চুমুক দিয়েই মুক্তির নতুন সূর্য এনেছে তারা। এক সাইকোপ্যাথের ভয়াল হিংস্র বাহুপাশ থেকে রক্ষা করেছে প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশকে।
তবে এই বিজয়ের জন্য বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। হাজারো ছাত্র-জনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শিশুসহ সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এনে দিয়েছে এই মুক্তি। গুলির মুখে বুক পেতে দেয়া আবু সাঈদ, আন্দোলনের মাঠে শ্রান্ত সহযোদ্ধাদের পানি খাওয়নো সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণ মুগ্ধ এবং তাদের মতো শত শত শহীদের রক্ত এই বিজয়ে শক্তি জুগিয়েছে। আমরা সেসব নাম জানা এবং না জানা শহীদদের প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা জানাই।
এটি এককভাবে কোটা আন্দোলনের কৃতিত্ব নয়। এ বিজয় সবার। গত ১৬ বছর যারা মাঠে নেমেছেন, মিছিল মিটিং আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, হত্যা-গুম খুন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, যারা বৈরী পরিবেশে, বছরের পর বছর কষ্টের মধ্যে বাস করেও গা বাঁচানোর চেষ্টা করেননি, একটু ভালো থাকার জন্য, সুযোগ থাকার পরও পক্ষত্যাগ করে আওয়ামী প্রলোভন উপেক্ষা করার সাহস দেখিয়েছেন, পত্রিকায় সাহসী কলাম লিখেছেন, রিপোর্ট করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদী পোস্ট দিয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছেন, সাহস জোগানোর চেষ্টা করেছেন, যারা দেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে নিপীড়িত হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, বিদেশে বসে দিনের পর দিন সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করে দেশের মানুষের কাছে স্বৈরাচারের নানা অপকর্মের তথ্য তুলে ধরেছেন, দুঃশাসনের স্বরূপ উন্মোচন করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছেন এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, বিদেশের মাটিতে লবিং করেছেন- তাদের প্রত্যেকের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে আজকের এই বিজয়ে। আমরা দলমত নির্বিশেষে তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
কিন্তু হাসিনার ক্ষমতার প্রাসাদ যে এত ঠুনকো ভাবা যায়নি। এ যেন আমেরিকার গর্বের প্রতীক টুইন টাওয়ার। সামান্য দু’টি ছোট বিমানের আঘাতে মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কী অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় এই পতন!
আসলে হাসিনার ক্ষমতার প্রাসাদের কোনো ভিত্তিই ছিল না। একটি সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি কী? এককথায়- জনসমর্থন। দ্বিতীয়ত- সুনির্দিষ্ট আদর্শ। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামের যে আদর্শটি আওয়ামী লীগ অনুসরণ করেছে সেটি যে মূলত রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল ছিল তা অন্ধ আওয়ামী নেতাকর্মী ছাড়া গোটা জাতির সামনে অনেক আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। সততা, নীতি-নৈতিকতা এসবের বালাই ছিল না আওয়ামী শাসনে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের সম্পদ লুটপাট ও চুরিচামারি। দেশের সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করে, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধসিয়ে দিয়ে একের পর এক ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখেছেন হাসিনা। পুরো দেশ যে তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, সেটি বোঝার মতো সাধারণ বুদ্ধিটুকুও তার ছিল না। দলের নেতা বা শুভাকাক্সক্ষীদের কথা শুনবেন তেমন বিবেচনাবোধও তার ছিল না। বাংলাদেশেরই একটি আদালত একসময় তাকে ‘হট হেডেড’ বলে অভিহিত করেছিলেন অহঙ্কার এবং পারিবারিক আত্মম্ভরিতায় তিনি ছিলেন অন্ধ। দলান্ধ মোসাহেব ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর নিঃশর্ত আনুগত্য ও তৈলমর্দন এবং সর্বোপরি প্রতিবেশী দেশের অনৈতিক অকুণ্ঠ সমর্থন তাকে ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের বাসিন্দায় পরিণত করে।
শেখ হাসিনা ছোট থেকেই অত্যন্ত বাচাল ও ঠোঁটকাটা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দায়িত্ব দেয়ার পর তার বেসামাল মুখ দলে আতঙ্কের কারণ হয়েছিল। হাসিনা কখন, কোথায়, কী বেফাঁস কথা বলে ফেলেন সেই ভয়ে থাকতেন নেতারা। ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা মুখের লাগাম ছুড়ে ফেলেন। যখন যা মনে এসেছে কিছুমাত্র না ভেবেই বলে ফেলেছেন। তার অমিয়বচন বিশ্লেষণ আমাদের লক্ষ্য নয়। পাঠককে শুধু মনে করিয়ে দিই যে, সেই বেলাগাম মুখই তাকে চূড়ান্তভাবে পদ্মায় চুবালো। দেশের সম্মানিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাউকে পদ্মায় ছুড়ে ফেলা, কাউকে চুবিয়ে তোলার সেসব দুঃখজনক বাকোয়াজ তাকে আম জনতার কাছে এবং পুরো বিশ্বে কতটা হীন ও নিচুমনা প্রমাণ করেছে টের পাননি।
গত ১৪ জুলাই। ছাত্রদের কোটা আন্দোলন তখনো একদম শান্তিপূর্ণ। ঠিক সেই সময় শেখ হাসিনা বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে?’ এই একটি বেফাঁস মন্তব্য কিভাবে গোটা আন্দোলনকে তীব্রতম গতি দিলো সেটি ভবিষ্যতে ইতিহাসের মুখরোচক উপাদান হয়ে থাকবে।
যাই হোক, শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, এটিই বাস্তব সত্য। দলের লাখো নেতাকর্মীকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি পালালেন। শুধু নিজের ছেলে আর বোনকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কিন্তু বিশ্বাস করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মেয়ে পালায় না’।
শেখ পরিবার এমনই। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর সবাই যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। তিনি ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে থাকলেন। কখন পাকিস্তানি সেনারা তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবে। দেশবাসীকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে বিশ্বের কোনো বিপ্লবী নেতা এভাবে শত্রুপক্ষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন, দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। সেই ইতিহাস বিশ্বাস করেনি বলেই স্বার্থপর হাসিনার পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী নেতাকর্মীদের কাছে পৃথিবীর সেরা বিস্ময় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু আমাদের আফসোস যে, আমরা নৃশংসতম খুনির পলায়ন রুখতে পারিনি। আশা ছিল, এ দেশেই তার বিচার হবে। আশা করব, পরবর্তী সরকার হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচার করবে।
ধারণা ছিল, আর কোথাও না হোক, ভারতই হবে হাসিনার শেষ আশ্রয়। শোনা যাচ্ছে, পেয়ারের ভারত তাকে নিয়ে মহাবিব্রত। আশ্রয়ও দিতে চাইছে না। হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি জীবনে ভুলবে না’। কিন্তু ভুলে গেল তো!
একজন দেশবিরোধীর পরিণতি কী হয় সেই উদাহরণ আমরা বহুবার বহুভাবে উল্লেখ করেছি যাতে হাসিনা শিক্ষা নেন। কিন্তু শিক্ষা নেয়ারও যোগ্যতা লাগে।
ভারত সিকিমের লেন্দুপ দর্জিকে আশ্রয় দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা তো দূরের কথা, একজন সাধারণ মানুষের সম্মানও তাকে দেয়া হয়নি। হাসিনারও সেই পরিণতি হবে নিশ্চিত।
বাংলাদেশ থেকে যা কিছু পাওয়ার ভারত তার চেয়েও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে। কিন্তু ঠিক সময়ে হাসিনাকে ছুড়ে ফেলে দিলো ব্যবহৃত টিস্যুপেপারের মতো!
দেশ ও জাতির শত্রুদের পরিণতি এমনই হয়। দর্জি, হাসিনা, মীরজাফর দেশের শত্রু। এরা ব্যক্তিস্বার্থে হাসতে হাসতে জাতির হাতে বিদেশের হাতকড়া পরিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের ফ্যানাটিক নেতাকর্মীরা সেই শৃঙ্খলকেই সোনার গয়না মনে করে পরস্পরের পিঠ চুলকায়।
‘ভারত আছে, আমরা আছি’ ওবায়দুল কাদেরের এমন এক দেশদ্রোহী বক্তব্য এ দেশের মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে। একবারও প্রশ্ন তোলে না, একটি স্বাধীন দেশের ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি, যিনি মন্ত্রীও, কিভাবে এমন কথা বলতে পারেন! প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিটের মাশুল চাইতে লজ্জা লাগে। দলের নির্বাচনী প্রার্থীরা প্রকাশ্য জনসভায় গলা ফাটিয়ে প্রচার করেন, ‘আমি ভারতের প্রার্থী’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে গিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার অনুরোধ জানান।
হাসিনা নিজে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে ভারতের রেল চলাচলের চুক্তি করে আসেন। সীমান্ত মুছে দেয়ার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেন। একটি স্বাধীন দেশে কী অবিশ্বাস্য সব ঘটনা! অথচ সবই ঘটেছে।
অবশেষে হাসিনা গেছে। বাংলাদেশের বিষফোঁড়া পেকে বিষাক্ত পুঁজ বেরিয়ে গেছে। এখন বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার সময়।
দরকার কালবিলম্ব না করে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দায়িত্ব দেয়া। গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। তাঁর ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।