মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ২৭, সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের প্রত্নস্থলগুলো আর কত অবহেলিত থাকবে?

Share on:

সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যময় নদ-নদী বঙ্গীয় উপত্যকাকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমরা আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশেষত প্রত্নস্থলগুলোকে পর্যটকের কাছে পরিকল্পিতভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হইনি।


এমন সময়ে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পর্যটন ও শান্তি’। অর্থাৎ পর্যটক যেন পর্যটনের মধ্য দিয়ে প্রশান্তি লাভ করেন। পৃথিবীর অনেক দেশ ইতোমধ্যে তাদের প্রত্নস্থলগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে সফল হয়েছে। বেশি দূর যেতে হবে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তাদের পর্যটন খাত। কিন্তু আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত এ দেশের প্রত্নস্থলগুলো!

প্রত্নস্থল সংরক্ষণ ও পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে আমরা কেন টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি না? একটি অঞ্চলের অতীতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে সে অঞ্চলের প্রত্নস্থলগুলো। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ দেশে পাঁচ শতাধিক প্রত্নস্থল সংরক্ষিত রয়েছে। সেসব ঐতিহ্যকে পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এ দেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধশত সরকারি এবং শ’খানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিষয় চালু থাকলেও কোথাও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন বিষয়ের ওপর বিশেষ কোনো বিভাগ নেই। ফলে উচ্চতর অধ্যয়নে পর্যটনের সঙ্গে অতিথিসেবা অর্থাৎ হোটেলের সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও পর্যটনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনো ধরনের পঠন-পাঠন ও গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এ ক্ষেত্রে আমাদের জানা সম্ভব হয় না, এ দেশে কোন ধরনের পর্যটক আসেন; কেন আসেন। এলেও কী কী দেখতে চান। অথবা অন্যান্য দেশে বিদেশি পর্যটকরা গেলেও আমাদের দেশে কেন আসেন না। এসব তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে পর্যটনের বিকাশে একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করা সহজতর হতে পারত।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কয়েক বছর আগে আমরা নিজেদের উদ্যোগে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন পরিত্যক্ত প্রত্নস্থলে অনুসন্ধানমূলক গবেষণা পরিচালনা করে অতীতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামের স্থানীয়দের হৃদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রত্নস্থল অনুসন্ধানের পাশাপাশি আমরা বর্তমানের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোর গুরুত্ব আমলে নিয়ে জাতিতাত্ত্বিক সমীক্ষা পরিচালনার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের গ্রামীণ জনপদের মানুষ যে কতটা অতিথিপরায়ণ, এটি জাতিতাত্ত্বিক সমীক্ষা বিশেষত অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ছাড়া উপলব্ধি করা অসম্ভব।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের অনেক গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রত্নস্থলের ধ্বংসাবশেষ। পাশাপাশি প্রাচীন করতোয়া নদীর একটি মরা খাত দেখে আমরা অনুমান করছি, অতীতের পুণ্ড্রনগর তথা মহাস্থানগড়ের সঙ্গে ধামাইনগরের গ্রাম বিশেষ করে ক্ষীরতলার যোগাযোগ হয়তো ছিল। ক্ষীরতলা মূলত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি গ্রাম। মাহাতো, ওরাওঁ, পাহান, মুরারি, সাঁওতাল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মানুষ এ গ্রামে কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করে থাকেন। তাদের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষও এই গ্রামে বাস করেন। কৃষিভিত্তিক এই জনগোষ্ঠী বছরের বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। পাশাপাশি নারীরা বিভিন্ন হস্তশিল্প বিশেষ করে নকশিকাঁথা, হাতপাখা, নানা ধরনের খেলনা তৈরি করে থাকেন। আমাদের প্রশ্ন, অতীত ও বর্তমানের এত চমৎকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ গ্রামকে কি আমরা পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছি?

গ্রামপ্রধান কৃষিভিত্তিক এই দেশে টেকসই পর্যটনশিল্পের বিকাশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে হোম স্টে পর্যটন। পর্যটকদের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে একটি ধরন হলো সাশ্রয়ী অর্থে যারা শান্তিদায়ক পর্যটনের আস্বাদ গ্রহণ করে। এ ধরনের পর্যটক পাঁচতারকা হোটেলের চেয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে অবস্থানকেই অধিক সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মনে করেন। এ ক্ষেত্রে আমরা অতিথিপরায়ণতাকে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে হোম স্টে পর্যটনের বিকাশে বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারি। এর মাধ্যমে একদিকে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্তকরণ সম্ভব হবে, অন্যদিকে স্থানীয়রা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অধিক মনোযোগী হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

এ ছাড়াও জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রত্নস্থলভিত্তিক পর্যটনশিল্পের বিকাশের মাধ্যমে এ দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ কিছুটা হলেও সম্ভব বলে আমি মনে করি।

দৈনিক সমকাল