সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বুধবার ১১, সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনুসন্ধান ও উৎপাদনের বিকল্প নেই

Share on:

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গে অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এ খাতকে সেবা খাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের সাধারণ মানুষ লাভবান হয়, তাদের জীবনমান বাড়ে, অর্থনীতিও সচল থাকে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জনবিমুখ ও আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতির কারণে এখন ঝুঁকিতে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।


জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে দ্বিগুণ। জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি উৎপাদন করা যায়নি। ফলে প্রতি বছর অলস বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ গুনতে হচ্ছে জরিমানা। ফলে খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দাম এবং দায় বেড়েছে সরকারের। আর অপ্রয়োজনীয় সক্ষমতা বাড়িয়ে ডেকে আনা হয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি। এছাড়া বিনষ্ট করা হয়েছে বিদ্যুতের প্রতিযোগিতার বাজার। ফলে মুনাফা লুফে নিয়েছে দেশের মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এছাড়া রিজার্ভ সংকটের কারণে আমদানিও করা যাচ্ছে না জ্বালানি। ফলে শহরের চেয়ে গ্রাম পর্যায়ে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ দেনা অপরিশোধিত থাকায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়ছে বাংলাদেশ। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দরকার অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও উৎপাদন।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎসংক্রান্ত মোট দায়ের পরিমাণ এখন ৩৭০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে আদানি বাংলাদেশের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায়। তার মধ্যে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ বিলম্বিত হয়েছে। পাওনা পরিশোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কবার্তা দিয়েছে আদানি। আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে আরো ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানেও বকেয়া পড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এখন জরুরি ভিত্তিতে ভারতের দেনা পরিশোধ করে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন।

দেশে একটা সময়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল না। এখন সক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বিগত সরকার নিজস্ব জ্বালানি—গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনে গুরুত্ব কম দিয়ে আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়েছে। এর আগে গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। আর এখন সক্ষমতা থাকলেও গ্যাস ও কয়লা সরবরাহ কম। ফলে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে একটি এনএলজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে শুধু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে চালানো যায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের কারণে বাকি সক্ষমতা ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে জ্বালানি তেলভিত্তিক ছয় হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও উচ্চ মূল্য ও জ্বালানি সংকটে সেগুলোও দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি ব্যবহার করা হয় না।

দেশে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। গড় সরবরাহ প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের (আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে)। জ্বালানির অভাবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। লোডশেডিংয়ের মাত্রা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জনজীবন বিপর্যস্ত।

আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন, দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা এলএনজির ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল নবায়নযোগ্য ও দেশীয় জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এলএনজি, জ্বালানি তেল প্রভৃতির বাজার অস্থিতিশীল। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে। সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনার বড় অংশই আমদানীকৃত এলএনজিকে ঘিরে। এর ওপর অধিক নির্ভরতা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া এলএনজির দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যায়, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব রাখে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাস সরবরাহ। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান আসায় স্বল্প মূল্যে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে এটি দেয়া গেছে। এতে স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদন করা গেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

সার্বিক সক্ষমতা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের আমদানিনির্ভরতা উচ্চাভিলাষী ও বাস্তববিমুখ পরিকল্পনা। আমরা এখনো প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টি নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সমাধানে আসতে পারিনি। অথচ এর সমাধানও রয়েছে। দেশীয় যেসব গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলনে আমরা কম গুরুত্ব দিচ্ছি। গোষ্ঠী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে গিয়ে জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধানের পথগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছি না। অথচ এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর এ মহাপরিকল্পনা সংশোধনপূর্বক দেশীয় উৎসনির্ভর করা প্রয়োজন। জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।

দৈনিক বণিক বার্তা