দ্রুত সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণ হোক
Share on:
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন ৫ আগস্ট। এর মধ্য দিয়ে টানা ১৫ বছর শাসনক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটল। এখন সময় এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের।
এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে তার সম্মতিও আছে বলে জানা গেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানিয়েছেন আজ রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হতে পারে। তিনি আরো জানিয়েছেন, এ সরকারের সদস্য সংখ্যা হতে পারে ১৫ জনের মতো। দু-একজন বেশিও হতে পারে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা উচিত। আমরা আশা করি, নির্ধারিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পেছানো হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এ গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। শুরু থেকে আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ, অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সংঘাত-সংঘর্ষ, বিশেষ করে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলনের পরিসর বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষও এতে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে সরকার কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে। সর্বশেষ সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সহিংসতা চালায়, দমন-পীড়ন শুরু করেছিল। বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনার পতন ও পতন-পরবর্তী সহিংসতায় অর্থাৎ ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে নিহতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। এসব ঘটনার মাঝে কোটা সংস্কার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ততদিনে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়ে ফেলে; ছাত্র ও নাগরিক সমাজ চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকার পতনের দাবিতে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। তবে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এবং সেই সরকারকে অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সরকার পদত্যাগের পর গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদসহ অনেক সাবেক নেতা, বিচারপতির বাসভবন, নানা স্থানে দোকানে ঢুকে লুটপাট ও ভাংচুর করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা ও লুটপাট হয়েছে যা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক ঘটনা। হামলা করা হয়েছে বিভিন্ন আওয়ামী পরিবারের ওপরও। এমনকি আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের বাসভবন ভাংচুরের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। ভাঙা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যও। পারতপক্ষে এসব ঘটনা রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বীজ বপন করা ছাড়া কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এসব অরাজকতা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনমনের চিত্রই তুলে ধরে।
যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার কথা, তারা নিজেরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যদিও তাদের প্রতি হামলাকে অনেকে রোষানল বলছেন, আন্দোলনজুড়ে তাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল। বিভিন্ন থানায়, পুলিশের ওপর হামলা করা হয়েছে, আগুন দিয়ে থানা পোড়ানো হয়েছে। এর ফলে পুলিশ কর্মবিরতিতে চলে গেছেন। কারাগার ভেঙে আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশও রাস্তায় নেই। শিক্ষার্থীরা সাময়িকভাবে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন, যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ দেশের তরুণরা যুগে যুগে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু চলমান সহিংসতা গণ-অভ্যুত্থানের সফলতাকে ম্লান করে দিতে পারে, যদি এখনো এসব সহিংসতা থামানো না যায়।
দেশে এখন কেবল রাষ্ট্রপতি আছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ এরই মধ্যে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
দেশে সরকার অনুপস্থিত। সরকার ছাড়া অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। তাই সবার আগে দরকার একটা সরকার প্রতিষ্ঠা। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে ও রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা রাখে এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের নিয়ে দ্রুত সরকার গঠন করতে হবে।
কোটা সংস্কারের দাবি পূরণ হয়েছে। দেশের স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। নতুন সরকারের মাধ্যমে দেশকে এবার গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়ার পালা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম কাজ হলো গণতন্ত্রের অন্যতম পরিচায়ক ‘স্বচ্ছ নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত করা, যার মাধ্যমে তাদের দায়িত্বের অবসান হয়।
গত তিনবারের নির্বাচন ছিল ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। এ শাসনামলে অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ মৌলিক অধিকারচর্চা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা। এমনকি খর্ব করা হয়েছিল গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও। সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছিল পোষ্য সংস্থা হিসেবে। শীর্ষস্থানীয় প্রশাসনিক ব্যক্তিরা ছিলেন সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত। যেসব দুর্নীতির খবর ধারাবাহিকভাবে ফাঁস হচ্ছিল—এমন সময় সরকারকেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে মূল্যায়ন না করে কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না, এমনকি সরকার নিজেই বেশি দিন শাসন কায়েম করতে পারে না—এ গণ-অভ্যুত্থান আগামী যেকোনো সরকারের জন্য এমন বার্তাই দেবে। আমরা প্রত্যাশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সবক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথকে সুগম করবে।