সাক্ষাৎকার প্রকাশনার সময়: সোমবার ২৯, জুলাই ২০২৪

দমন পীড়নের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি

Share on:

ড. নাওমি হোসাইন যুক্তরাজ্যের সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের গ্লোবাল রিসার্চ প্রফেসর। কাজ করেছেন বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগসহ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টেবিলিটি রিসার্চ সেন্টারে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাতকারটি নিচে তুলে ধরো হলো


news_392872_1

ছাত্রছাত্রীদের কোটা আন্দোলনের ন্যায্যতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

একটি দেশে মেধা বা যোগ্যতার চেয়ে কোটার ভিত্তিতে অর্ধেকের বেশি চাকরি বরাদ্দ থাকা যেকোনো পরিশ্রমী শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যারা একটি ভালো চাকরি ও দেশের সেবা করতে চান, তাদের জন্য খুবই হতাশাজনক।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বরাদ্দকৃত কোটার সবচেয়ে বেশি উপকারভোগী হয় সরকারের একটি নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী। এতে তরুণদের মনোবল ও আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরে। এছাড়া এ ধরনের ‍নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারি কর্মকর্তাদের মান, কর্তৃত্ব ও সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। অনেক বাংলাদেশী তরুণের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি দেখেছি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম রয়েছে এবং দেশের জন্য তারা মঙ্গলকর কিছু করতে চায়। তাদের অনেকেরই অভিনব পরিকল্পনা আছে এবং তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসরমাণও। আমি যখনই কোনো তরুণের সংস্পর্শে গিয়েছি, প্রায় সবসময় এমনটাই দেখেছি। বেশির ভাগ সময় দেখেছি তারা দুর্যোগের (কভিড বা বন্যা) সময় অসহায়, নিরুপায় মানুষকে সাহায্যের উদ্যোগ নিয়েছে। আবার কখনো দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা প্রদানে সহায়তার জন্য তারা একত্র হয়েছে কিংবা এমন কোনো নীতিনির্ধারণের জন্য কাজ করেছে যার উপকারভোগী সবাই হতে পারে। আমি অনুমান করতে পারি, যখন জানা গেল যে পিএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে, তখন এ তরুণরা কতটা হতাশাগ্রস্ত হতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় কোটা সংস্কার আন্দোলন, বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রতিবাদ যথাযথই ছিল এবং এ প্রতিবাদ কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের  হেয়প্রতিপন্ন করা হয়নি। আমার জানামতে, সবাই মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মকে অত্যন্ত সম্মান করে।

কিন্তু গত সপ্তাহে যখন সংঘাত-সহিংসতা শুরু হলো তার পর থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে আসলে কী হয়েছিল বা হচ্ছে তা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আটটি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি তারা ব্যাপক পরিবর্তন আনার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে। এরই মধ্যে সীমিত পরিসরে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে আন্দোলনের স্বরূপ বুঝতে কিছুটা হলেও এখন বেগ পেতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষ এখন ভীতসন্ত্রস্ত, নেতাদের চুপ করিয়ে রাখা হয়েছে, আন্দোলনকে ছন্নছাড়া করার চেষ্টা চলছে। তবে এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের সব জায়গায়ই। যেখানে প্রতিবাদকারীদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সহিংসতা চালানো হয় সেখানে কমবেশি এমন চিত্রই দেখা যায়। সহিংসতার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করা। তাই গত সপ্তাহ থেকে আন্দোলনে কী কী ঘটেছে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন। চাপা ক্ষোভ রয়ে যেতে পারে তবে আন্দোলনকারীদের সাংগঠনিক সক্ষমতা কেমন তা স্পষ্ট নয়।

আন্দোলনের ডাইমেনশন পরিবর্তনে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকা এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়ার পেছনে কার্যকারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে (শুধু বাংলাদেশ নয়, এবারের ঘটনায়ও নয়) শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সাধারণত ধাপে ধাপে আকারে বড় হতে থাকে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী, দাঙ্গা পুলিশ, নিয়মিত পুলিশ এমনকি কিছু জায়গায় সেনাবাহিনীর দ্বারা ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রমণের শিকার হতে থাকে। সরকারের কঠোর অবস্থান আন্দোলন দমন করতে পারে না। বরং তা প্রতিবাদকারীদের আরো উসকে দেয় এবং জনগণের সহানুভূতি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে থাকে। সরকার যদি পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয় বা চেষ্টা না করে, তাহলে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তেমন সহিংসতার সৃষ্টি হয়। 

এ আন্দোলনকে এত সংঘাত-সংঘর্ষে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি না। এতগুলো মানুষের প্রাণহানি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল অমূলক। সরকার যদি আগে থেকেই পদক্ষেপ নিত, ছাত্রদের কাছে পৌঁছে তাদের দাবি বোঝার চেষ্টা করত এবং নিজ সিদ্ধান্তে অনড় না থাকত তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়ানো যেত।

ছাত্র আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমন-পীড়ন কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, সবাই এ ঘটনায় মর্মাহত ও ভীতসন্ত্রস্ত। এর কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আপনার ক্ষমতা আছে মানে তার অপব্যবহারের পরিণতি নিয়ে আপনি চিন্তিত নন? এটি এক ধরনের ভয়াবহ ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না­—এটা কীভাবে সম্ভব? কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে মানুষ কি এ রকম মিথ্যের ধোঁয়াশায় থাকে?  এভাবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। হয়তো এত দ্রুত এতসব ঘটনা ঘটল বলে কর্তাব্যক্তিরা তা বুঝে উঠতে পারছেন না।  

আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে অনেক গ্রেফতার ও ধরপাকড় চলছে; যার বেশির ভাগই বিরোধী দলের সদস্য। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সত্যি কথা বলতে কি আমি আশ্চর্যান্বিত হই ভেবে যে জেলে বা নির্বাসনে নেই এমন বিরোধী নেতা নেই বললেই চলে। 

কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নতুন এ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব মহল থেকে কী প্রতিক্রিয়া আসতে পারে?

প্রকৃত বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন আর হত্যাযজ্ঞ কখনই এক মানদণ্ডে বিচার করা যায় না। সুতরাং নতুন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে নানা মহল থেকে বিবৃতি ও নিন্দা জানানো হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ কোত্থেকে আসছে এবং ক্ষমতা বা অর্থনীতির ব্যাঘাত ঘটাতে পারে কিনা সেটিই এখন প্রধান বিষয়। আন্তর্জাতিক চাপ হয়তো থাকবে কিন্তু তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশকে নিজেই এ জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

অর্থনীতিতে বছর দুয়েক ধরেই নানামুখী সংকট চলছে। সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতিতে আমরা কেমন প্রভাব দেখতে পারি?

এখান থেকে কোনো কিছু যদি ঘুরে দাঁড়ায় তা হয়তো অর্থনীতি।

দৈনিক বনিক বার্তা