দুই প্রতিবেশী দেশের সম্প্রতির গল্প
Share on:
আমি দুই স্তানের গল্প নিয়ে বসেছি। এর একটি আফগানিস্তান, অন্যটি তাজিকিস্তান। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশ সম্প্রতি তাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
এই অবস্থান ইসলাম ধর্ম নিয়ে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র কে কতটা সরাসরি দেশের নাগরিকদের জীবনের ওপর নাক গলাতে পারে, সে ব্যাপারে।
প্রথমে আফগানিস্তান। সাড়ে তিন বছর আগে সে দেশের মার্কিন সমর্থিত সরকারের পতনের পর যে তালেবান সরকার ক্ষমতায় এসেছে, অনেকেই ভেবেছিলেন তাদের পক্ষে পশ্চিমা বিরোধিতার মুখে টিকে থাকা কঠিন হবে। হয়নি, বরং উল্টো দেশটি তার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটের ওপর নিয়ন্ত্রণে এনেছে, এমনকি অর্থনীতিও সচল করতে সক্ষম হয়েছে।
তবে একটা ব্যাপারে আমাদের ভয় শুধু সত্যি প্রমাণিত হয়েছে তা-ই নয়, তা কয়েক গুণ বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিয়েছে। সেটি হলো সমাজে মেয়েদের অবস্থান। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও মেয়েদের ও নারীদের শিক্ষা ও কর্মের মতো একদম মৌলিক অধিকার সেখানে কার্যত অস্বীকৃত। আফগানিস্তানই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ের পর মেয়েদের জন্য স্কুলের দরজা বন্ধ।
ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তালেবান সরকার ১২ বছরের ঊর্ধ্বে সব মেয়েকে স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। আগে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তার বা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য লেখাপড়া করছিল, তাদের সে সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা আফগান মেয়েদের মৌলিক অধিকারের ওপর এই আক্রমণকে জেন্ডার অ্যাপারথেইড বা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নাম দিয়েছেন।
শুধু শিক্ষা বন্ধ করায় ক্ষান্ত হয়নি তালেবান সরকার। আগস্ট মাসে তারা এক নতুন আইন চালু করেছে, যেখানে মেয়েদের গলা উঁচু না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ৯০০ পাতা দীর্ঘ এই ফরমানে বলা হয়েছে, খুব জরুরি কাজ ছাড়া মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। আর গেলেও সঙ্গে কোনো পুরুষ অভিভাবক নিয়ে যেতে হবে। শুধু মাথার চুল ঢাকার হিজাব হলেই চলবে না, পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবৃত থাকতে হবে। মেয়েরা জনসমক্ষে কখনোই তাদের কণ্ঠ শোনাতে পারবে না। হাসা যাবে না, গান গাওয়া যাবে না। এই আইন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য নিয়োগ করা হবে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পুলিশ।
পুরুষদের জন্যও কতিপয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বয়ঃপ্রাপ্ত সব ছেলেকে দাড়ি রাখতে হবে। সে দাড়ি একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কম ছাঁটা যাবে না। প্রতিদিন নামাজ আদায় করতে হবে, রোজা রাখতে হবে। এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হলে আছে শাস্তি। বেত্রাঘাত থেকে জেল-জরিমানা এই শাস্তির অন্তর্ভুক্ত।
আফগানিস্তান বা তাজিকিস্তান এই দুই দেশের কোনোটাই আমাদের আদর্শ হতে পারে না। ধর্মাচার বা ধর্ম পালনের সম্মিলিত চেহারা অবশ্যই আছে, কিন্তু তার কোনোটাই রাষ্ট্রীয় অনুশাসন বা নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। জোর করে যেমন কাউকে অধিক ধার্মিক বানানো যায় না, তেমনি রাস্তায় পুলিশ ব্যবহার করে কারও ধর্মবিশ্বাস হরণ করা যায় না। পরিবর্তিত বাংলাদেশে এই দুই ধারার কোনোটাই কাম্য হতে পারে না।
এবার তাজিকিস্তান। আফগানিস্তানের ধরা পথের ঠিক উল্টো দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাজিকিস্তান।
সম্প্রতি সেখানে তারা আইন করে মেয়েদের স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরে ক্লাসে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। পুরুষদের দাড়ি রাখার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা এসেছে। দাড়ি রাখলে তা কতটুকু লম্বা করা যাবে, তার সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি ইসলামিক (বা বিদেশি) বিবেচিত এমন পোশাক পরা যাবে না। এসব পোশাক যা আসলে ঐতিহ্যগত ইসলামি পোশাক ছাড়া আর কিছুই নয়, তা পরলে বা বিক্রি করলে এই আইনে কড়া জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ছেলে-মেয়ে সবাইকেই মসজিদে ঘটা করে না যাওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অন্য কথায়, আফগানিস্তান যেখানে বলছে দাড়ি রাখো, বোরকা পরো, নামাজ পড়ো; তাজিকিস্তান সেখানে বলছে, না, সেসব থেকে তফাত যাও।
তাজিক সরকারের এই নয়া ব্যবস্থা কতটা হাস্যকর হতে পারে, তার এক উদাহরণ দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি জানিয়েছে, রাজধানী দুশানবের রাস্তায়, এমনকি ফাস্ট ফুড দোকানের সামনে কাঁচি হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যদি কোনো পুরুষকে পাওয়া যায়, যার দাড়ি প্রয়োজনের চেয়ে লম্বা, অমনি তা কচকচ করে কেটে দেওয়া হয়। হিজাব পরা মেয়েদের দেখলে তাদেরকে ধাওয়া খেতে হয় পুলিশের।
নিলুফার নামের এক তাজিক মুসলিম নারীর কথা উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, হিজাব পরে পথে নামলেই ভয় থাকে কখন পুলিশ তেড়ে আসবে। ইসলামিক বিবেচিত এমন পোশাক বা ব্যবহার নজরে এলে রয়েছে শাস্তির ভয়। শাস্তি বা জরিমানার পরিমাণও একদম কম নয়। টাইমস জানিয়েছে, অপরাধভেদে এই জরিমানার পরিমাণ ৬০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ ডলার। মনে রাখা ভালো, তাজিকিস্তানে গড়পড়তা মাসিক আয় মাত্র ২০০ ডলার।
ইসলাম প্রশ্নে আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানের এই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণ, একজন চায় দেশের মানুষ আরও বেশি করে ধর্মকে অনুসরণ করুক। অন্যজন চায় দেশের মানুষ ধর্মবিমুখ হোক। তালেবান চায় জোর করে হলেও দেশের মানুষকে তারা ‘সাচ্চা মুসলিম’ বানাবে। অন্যদিকে তাজিক সরকারের চোখে ইসলামি সন্ত্রাস ঠেকাতে যেভাবে সম্ভব ইসলামি ধর্মাচার থেকে সরে আসতে হবে। বলা বাহুল্য, মুখে যে যা-ই বলে সাফাই গাক, এই দুই দেশের গৃহীত ব্যবস্থায় দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে।
আমি অকারণে এই দুই ‘স্তানের’ গল্প আপনাদের শোনাচ্ছি না। সম্প্রতি বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরাচার অপসারিত হয়েছে, সর্বক্ষেত্রে সংস্কার ও পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এই তোড়জোড়ের মধ্যে আমরা কোনো মহল থেকে রাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ধর্ম ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি শুনতে পাচ্ছি। একটি ধর্মীয় দল ইতিমধ্যে যে পাঁচ দফা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে ‘ইসলামবিরোধী’ কোনো কিছু রাখা যাবে না।
নাগরিক ব্যবহারে বেশ কিছু পরিবর্তনও নজরে এসেছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নানা চর্চার ক্ষেত্রে নতুন কিছু দিক লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মাজার ও পীরের আখড়ার ওপর আক্রমণ এই নতুন ধার্মিকতার এক প্রকাশ্য চেহারা কি না, তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছে। মেয়েদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে তারা যেন স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে শালীন পোশাক পরে চলাফেরা করে।
এসব দেখেশুনে অনেকে খোলামেলাভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, নতুন বাংলাদেশ কি তাহলে নতুন ধর্মবাদী পথে এগোচ্ছে?
আমার মনে হয়, আফগানিস্তান বা তাজিকিস্তান এই দুই দেশের কোনোটাই আমাদের আদর্শ হতে পারে না। ধর্মাচার বা ধর্ম পালনের সম্মিলিত চেহারা অবশ্যই আছে, কিন্তু তার কোনোটাই রাষ্ট্রীয় অনুশাসন বা নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। জোর করে যেমন কাউকে অধিক ধার্মিক বানানো যায় না, তেমনি রাস্তায় পুলিশ ব্যবহার করে কারও ধর্মবিশ্বাস হরণ করা যায় না। পরিবর্তিত বাংলাদেশে এই দুই ধারার কোনোটাই কাম্য হতে পারে না।
আমরা জানি, ধর্ম পালন প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের শাসনতন্ত্রে সে অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এই স্বীকৃতির অর্থ কে কীভাবে ধর্ম পালন করবে, সেটি তার ব্যক্তিগত অধিকার। সেখানে রাষ্ট্র যদি উপযাচক হয়ে কোনো নির্দেশমূলক ধর্মনীতি চাপিয়ে দেয় এবং তা বাস্তবায়নে চাপ দেওয়ার পথ ধরে, তাহলে সেটা হবে সেই অধিকারের লঙ্ঘন। আমাদের দেশে সার্বিক সংস্কার নিয়ে সংলাপ শুরু হয়েছে। একদম গোড়া থেকেই যদি এই সাধারণ সত্যিটি আমরা স্বীকার করি, তাহলে আফগানিস্তান বা তাজিকিস্তানের মতো পথ অনুসরণের কোনো হুমকি থাকবে না।