মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১৪, সেপ্টেম্বর ২০২৪

তাহলে কি ‘আইনের শাসন’ অধরাই থেকে যাবে?

Share on:

কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন দমনে গতানুগতিক পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করে। একদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ শুরু করে, অন্যদিকে সে সময় সংঘটিত সব সহিংসতা ও নাশকতার দায় কেবল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দল দুটির নেতাকর্মীকে পাইকারি হারে জেলে ভরতে থাকে।


শুধু তাই নয়; বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীর পাশাপাশি হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হয়। এমনকি বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা হামলা চালানোর পর মামলা হয় ভুক্তভোগীদেরই বিরুদ্ধে। স্বাভাবিকভাবেই, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে এহেন প্রহসনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদ করে; অন্য সংবাদমাধ্যমের মতো সমকালও একাধিক সম্পাদকীয় লিখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ধারা বন্ধের দাবি জানায়।

অবশ্য, অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গণআন্দোলন দমনের এ অপকৌশল সরকারটির ১৫ বছরের মেয়াদে বহুবার কাজে দিলেও শেষমেশ ভোঁতা হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার্থী-জনতার প্রবল অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় নিতে হয়।

যদি বলা হয়, প্রচলিত আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে মানবাধিকারের লাঞ্ছনা ছিল বিগত সরকারের পতনের অন্যতম কারণ, তা হলে ভুল বলা হবে না। ফলে গণঅভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যখন আইনের শাসন ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ‘নতুন রাষ্ট্র’ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৮ আগস্ট শপথ নেয়, তখন তার সমর্থক তো বটেই সাধারণ জনগণের মধ্যেও আশাবাদ সৃষ্টি হয়। এমনকি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অনেক সমর্থকও প্রতিশ্রুত এ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে এক মাসের বেশি সময় পার করলেও অন্তত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। প্রথমত, এখনও একজন নাগরিক জানেন না, জানমালের সুরক্ষার প্রশ্নে কার দ্বারে গেলে তিনি কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবেন। অনেক ঘটনার ঘনঘটার পর পুলিশ কর্মস্থলে ফিরেছে প্রায় এক মাস হলো, এখনও খোদ থানাগুলোকেই নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দেশে ‘মব ট্রায়াল’ নামে নজিরবিহীন যে অরাজকতা তৈরি হয়েছে, যার শিকার হয়ে ইতোমধ্যে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি অনেক পুলিশও প্রাণ হারিয়েছেন, তার হুমকি এখনও এতটুকু কমেনি। মূলত ওই পরিস্থিতি শুধু পুলিশ নয়, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও যে ট্রমার মধ্যে ফেলেছে, তা বিদ্যমান অচলাবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সমস্যা হলো, দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ট্রমা থেকে বের করে আনার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়। কর্মস্থলে ফেরার আগে পুলিশ সদস্যরা কতগুলো দাবি পেশ করেছিলেন, পূরণ হলে যেগুলো হয়তো বাহিনীটিকে প্রণোদনা জোগাত; কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতির খবর কেউ জানে না।

সম্প্রতি আমরা দেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে, যিনি ১০ বছর আগে ছাত্রশিবিরের হামলায় এক পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন; গণপিটুনিরূপী মব ট্রায়ালের শিকার হয়ে অসহায় মৃত্যুবরণ করতে। এ ব্যক্তি তাঁর অসহায়ত্বের কারণে বিশেষ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট চাকরি পেয়েছিলেন, সেই সুবাদে স্ত্রীকে নিয়ে ক্যাম্পাসেরই একটা ছোট্ট ঘরে থাকতেন। মৃত্যুর মাত্র ৫ দিন আগে তাঁর কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সেই নিষ্পাপ-নিরীহ শিশুর দোহাইও তাঁকে বাঁচাতে পারেনি।

৫ আগস্ট দুপুর থেকে বিভিন্ন স্থানে বিশেষত বিগত সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রতিষ্ঠানে প্রাণঘাতী হামলা ও অগ্নিসংযোগের যে ভয়ংকর প্রবণতা শুরু হয়, তা এখনও বন্ধ হয়নি। নারায়ণগঞ্জে গাজী টায়ার্সে যে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট ও ভস্মীভূত হলো; এমনকি সে আগুনে পৌনে দুইশ মানুষ ছাই হয়ে গেল, তা নিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষই কিছু বলেনি। সম্ভবত এ থেকে আশকারা পেয়েই বুধবার গাজীপুরে বেক্সিমকোর রাসায়নিকের কারখানায় আগুন দেওয়া হলো। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এ ধ্বংসযজ্ঞ যে কতটা আত্মঘাতী, তা বোঝার যেন কেউ নেই! এগুলো শুধু সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার পরিবারের উপার্জনের পথই বন্ধ করে দিচ্ছে না, দেশটাকেও অন্তত কয়েক দশক পিছিয়ে দিচ্ছে।

যদি এ সময়ে সংঘটিত ভিন্ন ধর্ম, মত ও দর্শনের অনুসারীদের ওপর হামলার কথা বলা হয়, তাহলে হয়তো পাঠকেরও ধৈর্য থাকবে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলার বিষয়টি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক স্তরেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে, তা আমরা জানি। খোদ প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন। তবে এতে পরিস্থিতি কতটুকু বদলেছে, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে খুলনায় ১১ বছরের কিশোর উৎসব মণ্ডলের সঙ্গে কী ঘটেছে, তাও কারও অজানা নয়। কিন্তু গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে কয়েক ডজন মাজার ধ্বংস করা হলো, এ নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ক্ষীণস্বরে কিছু কথা বললেও তা বন্ধে আশু কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শত শত বছর ধরে চলা মাজার সংস্কৃতি এ দেশে ইসলামের একটা বিশেষ ধারা হিসেবে চর্চিত হয়ে আসছে। শুধু মুসলমানদের ব্যাপক অংশ নয়, অমুসলিমদেরও অনেকে এর সঙ্গে যুক্ত। সত্য, এ নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ একে ইসলামের বিকৃতি ঘটানোর জন্যও দায়ী করেন। কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির জীবনযাপন ও প্রার্থনা রীতি অনুসরণের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার যে মাজারপন্থি মানুষেরা রাখেন– সে কথাটি জোরদারভাবে উঠছে না।

এদিকে পুলিশ মব ট্রায়াল বা উল্লিখিত ঘটনাবলি ঠেকাতে না পারলেও আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পাইকারি হারে মামলা গ্রহণ ও দায়েরে কিন্তু একটুও ক্লান্তিবোধ করছে না। মানুষ অবাক হয়ে দেখছে, যেখানে জনদাবি হলো বিগত সরকারের সময়ে সংঘটিত গুম, খুন, অপহরণ; সর্বোপরি সাম্প্রতিক আন্দোলনে নির্বিচারে মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে এসব অপকর্মের পরিকল্পনাকারী বা নির্দেশদাতাদের বিচারের আওতায় আনা, সেখানে মামলা হচ্ছে বাছবিচার ছাড়া। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের ঢালাও গ্রেপ্তার ও গয়রহ মামলার মাধ্যমে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই ঘায়েল করা হয় না; এক ধরনের গ্রেপ্তার-বাণিজ্যও চলে। এখনও তা চলছে না– হলফ করে কেউ দাবি করতে পারবে না। বিশেষত অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের পুনরাবৃত্তি চলছে বলে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে।

রিমান্ডের নামে যা চলছে, তাও একেবারে গতানুগতিক। বিগত সরকারের সময় এ বিষয়ে উচ্চ আদালত সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যেগুলোর পদে পদে ব্যত্যয় তখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। হতাশার কথা হলো, এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যারা ক্ষমতায় এলেন, তারাও রিমান্ডের সেই পুরোনো ধারাই অনুসরণ করছেন। অন্যদিকে, উচ্চ আদালতও বিষয়টি নজরদারি করছেন– এমনটা বলা যায় না। আগে তো অন্তত গায়েবি মামলা হলে ভুক্তভোগী উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে আগাম জামিন চাইতে পারতেন, এখন কিন্তু তেমন সুযোগ কোনো ভুক্তভোগী পাচ্ছেন বলে দেখা যাচ্ছে না।

প্রধান উপদেষ্টা বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা হিসেবে বলছেন, অচিরেই বিচার বিভাগ ও পুলিশে সংস্কার হবে, তখন সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে মানুষ যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, তারা তাহলে প্রতিকারের আশায় কোথায় যাবেন? আইনের শাসনও কি ততদিন স্থগিত থাকবে?

দৈনিক সমকাল