তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ‘নরম-গরম’, চুক্তি ঝুলিয়ে রেখে লাভ হচ্ছে টা কার?
Share on:
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া বহুল আলোচিত সাক্ষাৎকারে ‘নরমে-গরমে’ এমন কিছু কথা বলেছেন, যা আগে কোনো সরকারপ্রধান অন্তত প্রকাশ্যে বলেননি।
তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন অমীমাংসিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে দুই দেশের মতপার্থক্য দূর করার উপায় নিয়ে তাঁর নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে কথা বলবে। কারণ চুক্তিটি ঝুলিয়ে রেখে কোনো দেশেরই লাভ হচ্ছে না।
এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পিটিআই প্রতিনিধি প্রদীপ্ত তপাদার আরও সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব সুরাহা করতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কি ‘পুশ’ বা জোর ধাক্কা দিতে চাইছে? উত্তরে মুহাম্মদ ইউনূসও সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন- “পুশ একটি বড় কথা; আমি সেটা বলছি না। আমরা এটা ‘পারস্যু’ বা পারস্পরিক আলোচনা করব। আমাদের একত্রে বসতে হবে এবং বিষয়টি সমাধান করতে হবে।” (পিটিআই ওয়েবসাইট, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
আমরা জানি, তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি কেবল আলোচনা করে সমাধান সম্ভব নয়। নদীটি নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেই দুই দেশের মধ্যে নদীবিষয়ক প্রথম আলোচ্যসূচিতেও তিস্তা ছিল। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত ছিল। পরের ইতিহাস সবার জানা। হিসাব করে দেখেছি, গত ৫৩ বছরে তিস্তা সমস্যার সমাধানে ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে অন্তত ৩৫ বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘এটা কোনো নতুন ইস্যু নয়, বরং অনেক পুরোনো ইস্যু। আমরা অনেকবারই এ নিয়ে কথা বলেছি। আলোচনা শুরু হয়েছিল সেই পাকিস্তানি শাসনামলে। একসময় আমরা সবাই চেয়েছিলাম, চুক্তিটি চূড়ান্ত হোক; এমনকি ভারতীয় সরকারও প্রস্তুত ছিল। যদিও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল না। আমাদের এটা সুরাহা করতেই হবে।’ (পিটিআই ওয়েবসাইট, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
আমরা দেখেছি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনেকবার তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের তাগিদ দিয়েছেন। প্রায় প্রতিবারই পারস্পরিক সফরের যৌথ বিবৃতিতে ইস্যুটি স্থান পেয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি চীনের সহায়তায় তিস্তার জন্য ‘বিকল্প ব্যবস্থা’ করতে চেয়েছেন; সেটাও শেষ মুহূর্তে ভারতের বাগড়ায় ভেস্তে গেছে। শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরে, ২১-২২ জুন ২০২৪, তিস্তার কফিনে কার্যত শেষ পেরেক মারা হয়ে গিয়েছিল।
সফরটি শেষে এক নিবন্ধে লিখেছিলাম- “এবারের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি কার্যত হিমাগারে চলে গেল। বরং উজানের দেশ থেকে পানিপ্রাপ্যতার অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশ যে নিজস্ব সীমানার মধ্যে চীনের সহায়তায় একটি কারিগরি সমাধানের কথা ভাবছিল, সেটাই ভারত বাস্তবায়ন করে দিতে চাইছে। এমনকি অনেক বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা পানি বণ্টনের বদলে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার যে কথা বলে আসছেন, এই প্রস্তাবে সেটাও নাকচ হয়ে গেছে। কারণ প্রকল্পটি ভারত বাস্তবায়ন করতে চাইছে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে’। তিস্তা অববাহিকাজুড়ে, বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে নয়”। (তিস্তা পরিস্থিতি তাহলে কী দাঁড়াল, সমকাল, ২৪ জুন ২০২৪)।
বস্তুত সাত দশকের বেশি সময় চেষ্টা করেও যখন সমাধান মেলে না, তখন তিস্তা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অর্থহীনতা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ইস্যুটি যে আন্তর্জাতিক পর্যায়েই নিতে হয়, সেটাও কোনো সরকারপ্রধানকে মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। আক্ষেপের বিষয়, দুই দশক ধরে লিখে লিখেও এই সরল অঙ্কটি বিগত সরকারগুলোকে বোঝানো যায়নি, অথবা তারা বুঝতে চাননি।
আশার কথা, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস পিটিআইর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রাঞ্জল ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘এই সমস্যার সমাধান আমাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ীই করতে হবে। ভাটির দেশগুলোর কিছু সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে এবং আমরা সেই অধিকার পেতে চাই।’ (পিটিআই ওয়েবসাইট, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
আমার মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছোট্ট ব্যাক্য দুটির তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান এই প্রথম তিস্তা ইস্যুটির সমাধান আন্তর্জাতিক নিয়ম এবং ভাটির দেশের অধিকারের কাঠামোর মধ্যে খোঁজার ‘দুঃসাহস’ দেখালেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভাটির দেশের জন্য এমন আন্তর্জাতিক নিয়ম ও রক্ষাকবচ কি রয়েছে? উত্তর হচ্ছে– হ্যাঁ; একটি নয়, দুটি রক্ষাকবচ রয়েছে।
নদ-নদীর ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা যখন পথ হারায়, তখন ভাটির দেশের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায় যে দুটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো, এর প্রথমটি ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস’, যেটি সংক্ষেপে ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ, ১৯৯৭’ নামে পরিচিত। এই সনদ বা কনভেনশন যে কোনো ভাটির দেশের জন্য প্রায় অব্যর্থ রক্ষাকবচ। এতে স্পষ্টভাবে মানুষের অধিকার রক্ষায় নদীর অধিকারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়টির পোশাকি নাম ‘কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অ্যান্ড ইউজ অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটারকোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস’। সংক্ষেপে বলা হয় ‘ওয়াটার কনভেনশন। বাংলায় বললে ‘জাতিসংঘ পানি সনদ, ১৯৯২’। দ্বিতীয়টি নানা দিক থেকে প্রথমটির চেয়ে সহজ, কার্যকর ও সুবিধাজনক। (আগ্রহীরা পড়ুন, হেলায় ফেলে রাখা আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ; সমকাল, ১৩ অক্টোবর ২০২১)।
আক্ষেপের বিষয়– না প্রথম, না দ্বিতীয়টি, বাংলাদেশ কোনোটিকেই এখন পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারেনি। বিশেষত প্রথমটি নিয়ে বাংলাদেশের ব্যর্থতা মহাকাব্যিক। ‘পানিপ্রবাহ সনদ, ১৯৯৭’ জাতিসংঘে পাসের সময় স্বাভাবিকভাবেই উজানের দেশ ভারত এর বিপক্ষে এবং ভাটির দেশ বাংলাদেশ এর পক্ষে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের সনদে শুধু ভোট দিলে বা স্বাক্ষর করলেই চলে না; নিজ দেশের আইনসভায় ‘র্যাটিফাই’ বা অনুসমর্থন করতে হয়। রিভারাইন পিপলসহ বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই এই দলিল অনুসমর্থনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ নেই!
বিএনপির শাসনামল ২০০১-২০০৬ সালে পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ অনুসমর্থনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ছিলেন। সভায় অংশগ্রহণকারী ১৭ জনের মধ্যে ১৬ জনই মত দিয়েছিলেন, এই দলিল অবিলম্বে অনুসমর্থন করা উচিত। কিন্তু বোধগম্য কারণে ওই প্রক্রিয়া আর অগ্রসর হয়নি।
বলতে গেলে, নিয়তির আশীর্বাদ! যখন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিস্তার পানির প্রশ্নে ‘আন্তর্জতিক নিয়ম ও ভাটির দেশের অধিকার’ নিয়ে কথা তুলেছেন, তখন তাঁরই সরকারে আইন, বিচার ও সংসদ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছে্ন আসিফ নজরুল। তিনি অতীতে অনেকবারই সনদটি অনুসমর্থন না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন। বল এখন তাঁরই কোর্টে। দ্বিতীয় রক্ষাকবচ গোড়াতে কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য নির্ধারিত থাকলেও ২০১৫ সাল থেকে তা বিশ্বের সব দেশের জন্য উন্মুক্ত। ২০২১ সালে আয়োজিত ভার্চুয়াল যে ‘কপ’ আয়োজিত হয়েছিল, সেখানে আমিও আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। দেখেছি, সনদটির কর্তৃপক্ষ ইউএনইসিই বাংলাদেশের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে যখন ভাটির দেশের রক্ষাকবচ দুটি হেলায় ফেলে রেখেছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকার কি এগুলোর সদ্ব্যবহারে উদ্যোগী হবে না? অন্যথায় নরম-গরম কথায় কেবল হাততালিই মিলবে; ধুঁকতে থাকা তিস্তাসহ যৌথ নদীগুলোর সংরক্ষণ ও সুরক্ষা সম্ভব হবে না।