তৈরি পোশাক খাতে বিদেশী ক্রেতাদের ‘আস্থা অর্জনে’ উদ্যোগ নিন
Share on:
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম তৈরি পোশাক শিল্প খাত। কিন্তু গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই খাতটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। পোশাক শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভের জেরে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আলোচনার ভিত্তিতে তা সমাধানও করা হয়েছে।
কিন্তু এবার পোশাক খাতে শুধু নারী নয় সমানসংখ্যক পুরুষ কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, হাজিরা বোনাস প্রদান এবং আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়াসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলন শিল্পাঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ দফায় দফায় আলোচনা করেও এ খাতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারছে না। ফলে নিরাপত্তার অভাবে বাধ্য হয়ে মালিকপক্ষ সাধারণ ছুটিসহ অনির্দিষ্টকালের জন্য পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করছে।
এ অস্থিতিশীলতার কারণে এ খাতের উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পোশাক শিল্প মালিকরা ক্রেতাদের চাহিদামতো যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন। এরই মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে। এ খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এ ধরনের অস্থিরতার কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। চলমান অস্থিরতা পোশাক খাতকে ধ্বংসের পাশাপাশি রফতানি আয়কে প্রভাবিত করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে। সরকারকে এ খাতে অস্থিতিশীলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি নিরপেক্ষ ভূমিকায় কাজ করতে হবে। পোশাক শিল্প রক্ষায় দায়িত্বশীল সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে দেশে এ মুহূর্তে একটি নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশ ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের কাজ চলছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ খাতে এ ধরনের অস্থিতিশীলতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শ্রমিক নেতারা বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, ঝুট ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে। কারখানাগুলোয় নেতৃত্বের পালাবদল ও শ্রমিক সংগঠনের কমিটিগুলোয় নিজেদের কর্তৃত্ব নিতে পেছন থেকে ইন্ধন দিয়ে শিল্পকে অস্থির করার পাঁয়তারা চলছে।
তাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বেকার সমস্যা সমাধানে এবং অর্থনীতির বিকাশে এ খাতের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এ খাতে অস্থিতিশীলতা যদি জিইয়ে থাকে তাহলে এর বিরূপ প্রভাব কতটা বহুমুখী হতে পারে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অচলাবস্থার অবসান যেকোনো মূল্যে করতেই হবে। সবার আগে মালিকপক্ষের যথাযথ ভূমিকা প্রয়োজন। শিল্পাঞ্চলে ভাংচুর, লুটপাট বন্ধে যূথবদ্ধ প্রয়াস চালানোর বিকল্প নেই। অনুকূল ব্যবসা পরিবেশ তৈরি করা সবার স্বার্থেই জরুরি। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের লক্ষ্যে অর্থনীতির জোগানদাতা এ খাতে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে থাকুক তা শুভবোধসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। কেননা উৎপাদন ব্যবস্থায় অভিঘাত লাগলে এ খাতের বহুমুখী বিরূপ প্রভাব যে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আশুলিয়া ও গাজীপুরে চলমান অস্থিরতার কারণে গতকাল অর্ধশতাধিক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, জিরানী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রাম এলাকায় মোট পোশাক কারখানা রয়েছে ২ হাজার ১৪৪টি।
আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বল্প পরিসরে একটি অপ্রচলিত রফতানি খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প খাত। এ খাতের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। মাত্র ১২ হাজার ডলার রফতানি আয় দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশই অর্জিত হচ্ছে এ খাত থেকে। বলা যায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে। অন্তত ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী। এছাড়া ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড মিলিয়ে শিল্প খাতটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৫ কোটি লোক জীবন-জীবিকার জন্য এ শিল্পের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়েছে এ খাত।
দেশে এ খাত বিকশিত না হলে বেকার বহুগুণ বেড়ে যেত। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়েও এ খাত এগিয়েছে। দেশের বিকাশমান এ শিল্পকে ধ্বংস করে যারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করা দরকার।
কেননা এ খাত ধ্বংস হয়ে গেলে দেশে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না এবং বেকারত্ব বাড়বে। এ খাতের অস্থিতিশীতা শুধু অর্থনীতিকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলবে না, বরং সংশ্লিষ্ট অন্য খাতগুলোর আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যাবে। মোট কথা, যারা এ খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিক্ষুব্ধ শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তবে তাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিল্প পুলিশকে কার্যকর করতে হবে। এছাড়া মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা। শ্রমিকদের শোষণ করে একচেটিয়া মুনাফা করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। পোশাক কারখানা চালু থাকার অর্থ অসংখ্য শ্রমিকের জীবনমানের ভিত শক্ত থাকা। তাই এ নিয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র, আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড দমনে কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে।