ঢালাও মামলায় শহীদরা কি ন্যায়বিচার পাবে?
Share on:
তরুণদের নেতৃত্বে, সর্বস্তরের জনতার সম্পৃক্ততায় যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা অসাধারণ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। বিগত সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন বলপ্রয়োগে দমাতে চেয়েছে।
আন্দোলনকারীদের দমাতে গিয়ে অনেক রক্ত ঝরিয়েছে, যা সর্বস্তরের জনগণকে এতে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেছে।
আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে মোটাদাগে দুটি দাবি উচ্চারিত হয়েছে। একটি হলো, যারা অন্যায়-অপরাধ করেছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি গত দেড় দশকে যারা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা আবশ্যক। তবে বিচারটি হতে হবে নিরপেক্ষ, যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি কোনোভাবেই অভিযুক্ত না হয় এবং শাস্তি না পায়।
আমার পর্যবেক্ষণে তিন ধরনের অপরাধের বিচার হওয়া জরুরি। এর মধ্যে প্রথমটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। ছাত্রদের আন্দোলনে সহস্রাধিক প্রাণ ঝরে পড়েছে। তাদের ‘অপরাধ’ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা সোচ্চার হয়েছে, মাঠে নেমেছে। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের আইনানুগভাবে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলো বিচারে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাই। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আইনেও স্বীকৃত। সেভাবেই এর বিচারের ব্যবস্থা করা চাই।
দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে গুম-খুনের মতো যে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তারও বিচার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি আয়নাঘরের মতো বন্দিশালায় রেখে মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। যারা এসব অপরাধ করেছে, দণ্ডবিধিতেই তাদের শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে; সে অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ফৌজদারি অপরাধের জন্য দেশের আইনই যথেষ্ট। এর প্রয়োগ নিশ্চিতের বিষয়টি সরকার নিশ্চয়ই তার অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করবে।
তৃতীয়ত, গত সরকারের আমলে যারা আর্থিক অপরাধ করেছে তথা প্রতিষ্ঠান লুট, ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি করেছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থ বিদেশে পাচারও গুরুতর অপরাধ। এটি মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নেওয়ার শামিল। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও তারা বিপদে ফেলেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা ক্ষমতাসীনদের প্রভাবিত করে যারা এসব আর্থিক অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি না হলে অপরাধের ধারা চলতেই থাকবে। ব্যাংক লুট, জ্বালানি খাতে লুণ্ঠন, মেগা প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতি এ রকম আর্থিক ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় অনিয়ম হয়েছে, তা খুঁজে বের করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া কাম্য।
আমরা দেখেছি, এসব অপরাধের বিচারের জন্য ইতোমধ্যে অনেক মামলা করা হয়েছে; অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছে। কিন্তু অনেক মামলায় যেভাবে ঢালাওভাবে অপরাধী করা হয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সত্যিকার অর্থেই যারা দোষী, তাদের যদি অপরাধী না করে প্রতিহিংসাবশত নিরপরাধ কাউকে আসামি করা হয়, তাতে এসব মামলার মাধ্যমে সত্যিকার প্রতিকার বা অপরাধীর বিচারের প্রত্যাশা করা নিরাশায় পরিণত হতে পারে। অনেকেই ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়কে গুরুত্ব দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।
এ লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে একটি ‘লিগ্যাল সেল’ তৈরি করা দরকার বলে আমি মনে করি। সেখানে উল্লখযোগ্যসংখ্যক, যেমন ৫০ বা ১০০ জন আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর উদ্দেশ্য হবে যেসব পরিবারের সদস্য হত্যা, গুম ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হয়েছে, তাদের যথাযথ আইনি সহায়তা দেওয়া। সঠিক তদন্ত করাও এই লিগ্যাল সেলের অন্যতম কাজ হবে। অর্থাৎ দ্রুত ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে কার্যকরী সব পদক্ষেপের জন্য ‘লিগ্যাল সেল’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আর্থিক অপরাধে অপরাধী শনাক্ত ও বিচার অত্যন্ত জটিল কাজ। সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যারা এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারবে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে; দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিতে পারেন। যেমন ফরেনসিক অডিট একটা জটিল বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে আমিও দু-একজনকে চিনি, যারা এ ব্যাপারে সানন্দে সরকারকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
সম্প্রতি উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা হচ্ছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিহিংসা কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত এমনটি করা হচ্ছে– এ অভিযোগ উঠেছে। এগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি অপরাধী হন তাহলে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, কিন্তু তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এটা হবে আত্মঘাতী। কারণ সেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা কারখানায় অনেক মানুষ কাজ করে, তাদের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। সোমবারও আমরা সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা দেখেছি। যার কারণে শতাধিক কারখানায় উৎপাদন বন্ধের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কারখানার নিরাপত্তা সরকারকে দিতেই হবে। স্বস্তির বিষয় হলো, এ পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অস্থিরতায় ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এর বাস্তবায়ন জরুরি, যাতে কোনোভাবেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রমণের শিকার না হয় এবং বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে না পড়ে।
মামলার কার্যকর তদন্ত ও বিচার এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্নীতিগ্রস্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার কারণে স্বৈরাচারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাহিনী ভেঙে পড়েছে। তাই দ্রুততার সঙ্গে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠন এবং সক্রিয় করতে হবে, যাতে তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে। দক্ষতা ও সততার সঙ্গে তারা যত দ্রুত জনগণের সেবা দেবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
মামলার ক্ষেত্রে আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি, নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়। তাই মামলাগুলো অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। মামলার বিবরণীতে অপরাধ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আসামি করতে হবে। ভুয়া মামলা হলে শহীদের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। শহীদ পরিবার ন্যায়বিচার না পেলে অন্তর্বর্তী সরকার নৈতিক বৈধতা হারাবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যারা গুলি করেছিল; গুলির আদেশ দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা করতে হবে। পুলিশ যাতে স্বচ্ছ তদন্ত করে প্রকৃত দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলে, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।