ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্যের কাছে যত প্রত্যাশা
Share on:
অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নেতৃত্ব অধিষ্ঠিত হয়েছে। অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছেন। প্রথমেই তাকে অন্তর্ময় অভিনন্দন। বেশির ভাগ মানুষই তাকে আখ্যায়িত করেছেন যোগ্য ব্যক্তিত্ব, নিবেদিত শিক্ষক, খ্যাতিমান গবেষক এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে।
এ জনমূল্যায়নের সঙ্গে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই এবং তাকে আমি চিনি। তার মেধা, প্রজ্ঞা, প্রতিভা অত্যন্ত দীপ্তমান। সুতরাং সবাই আশা করছেন যে তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার দেশের শীর্ষস্থানীয় মেধা-নেতৃত্বদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়ে তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা নেতৃত্বের কথা যখন ওঠে, তখন জানা দরকার, আসলে এ মেধা নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়। মনে রাখা দরকার, আমরা যখন মেধা নেতৃত্বের কথা বলি, তখন শুধু শিক্ষাগত উৎকর্ষ বা বিদ্যা অর্জনের কথা বলি না, মেধা নেতৃত্বের কথা বলতে আমরা মনন, চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তি এবং একটি উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলি। সুতরাং সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে মেধা নেতৃত্বের পাঁচটি মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, মেধা নেতৃত্ব দিতে হলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববীক্ষণ এবং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান যদি চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে, মননের ক্ষেত্রে কূপমণ্ডূক হয় তাহলে তার পক্ষে মেধা নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, মেধা নেতৃত্ব দিতে হলে মন ও চিন্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা থাকতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে মেধা নেতৃত্বদানকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আধার হতে হবে। তৃতীয়ত, মেধা নেতৃত্ব দিতে হলে মেধা নেতার প্রয়োজন হবে। সেই মেধা নেতার একদল হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং অন্য দল হবেন শিক্ষক ও গবেষকরা। মেধা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য শিক্ষক ও গবেষককে যেমন উচ্চ মানের হতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শাণিত হতে হবে সর্ব অর্থেই। চতুর্থত, মেধা নেতৃত্ব দিতে গেলে পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা শ্রেণীকক্ষের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, শ্রেণীকক্ষের বাইরে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে জ্ঞান রয়েছে, তা আমাদের জানতে হবে এবং পঞ্চমত, মেধা নেতৃত্ব মানে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জন নয়, শুধু নেয়া নয়, মেধা নেতৃত্ব মানে দেয়াও; দেশ ও জাতির জীবনের বহু ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে।
এ পাঁচ নির্ণায়কের পরিপ্রেক্ষিতে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আমরা তাকাই, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা নেতৃত্ব দিতে পেরেছে। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এ অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার জন্য, তখন কিন্তু এর গঠন ও কাঠামো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে ও আদলে করা হয়েছিল। সুতরাং জন্মলগ্ন থেকেই কিন্তু একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষিত ও বীক্ষণ নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু।
বিশ্ববীক্ষণের ক্ষেত্রে দেখেছি যে জন্মের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছে, বিশ্বের নানান মনীষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন—রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, ওস্তাদ বড় গোলাম আলী এসেছিলেন। সম্মাননা দেয়া হয়েছে মিসরের পূর্বতন রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়াত জামাল আবদেল নাসেরকে। সুতরাং বিশ্বের জ্ঞান, মনন, চিন্তাচেতনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্তি—এটা অনেক আগেই হয়েছিল এবং অতীতে আমরা এটা বারবার দেখেছি।
দ্বিতীয়ত, মুক্ত বুদ্ধি বা মুক্ত চিন্তার কথা যদি বলি, তাহলে ত্রিশের দশকে আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তির’ যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার আধার কিন্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বুদ্ধির মুক্তির সে সংগ্রাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারবার করেছে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক শাসনের সময়ে। তার জন্য হেনস্তা করা হয়েছে ছাত্র-শিক্ষকদের, আঘাত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়িত হতে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছপা হয়নি।
মেধা নেতার কথা যদি বলি, তবে তালিকা করার প্রয়োজন নেই, কারণ সে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। প্রথম থেকেই বিশ্বের নানা জ্ঞানী-গুণীজন, বিদগ্ধ মানুষ ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, গবেষণা করেছেন। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের গবেষণা অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ই করেছেন। সুতরাং বিশ্বমানের একটি গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভূমিকা রেখেছে। দশকে দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাসম্পন্ন শাণিত বুদ্ধির শিক্ষার্থী তৈরি করেছে, যারা বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে গিয়ে বৈশ্বিক চিন্তাচেতনা, মনন ও অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রেখেছেন। সুতরাং মেধা নেতার ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে ছিল না।
পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে যদি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করি, তাহলে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অর্থাৎ যা কিছু আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করে, সেসব ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্যিক সৃষ্টি করেছে, শিল্পকলায় নতুন নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে, দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তাচেতনার জন্ম দিয়েছে।
শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম যে শুধু মেধাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হলেই মেধা নেতৃত্ব দেয়া যায় না, মেধা নেতৃত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে জাতি ও সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের সব ধরনের সামাজিক আন্দোলনে, মুক্তিবুদ্ধির আন্দোলনে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি রক্তক্ষরা ভূমিকা রেখেছে। আমার জ্ঞান সীমিত, কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের আন্দোলনে, সংগ্রামে ও স্বাধীনতার লড়াইয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার জানা নেই।
ভাষা আন্দোলনে, ষাটের ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বাঙালি জাতি ভোলেনি এবং তা মনে রেখেছে পাকিস্তানি শাসকরাও। তাই ২৫ মার্চে তারা যখন আক্রমণ চালিয়েছে, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীরা যুদ্ধ করেছেন এবং শহীদ হয়েছেন। বিজয় যখন আমাদের দোরগোড়ায়, তখন পাকিস্তানি শাসকরা তুলে নিয়ে গেছে আমাদের মেধার আকর মনীষীতুল্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এবং তাদের হত্যা করেছে নির্মমভাবে। কারণ তারা জানত যে মেধা ও মননের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাকে যদি ধ্বংস করে দেয়া যায়, তাহলে বাঙালি জাতির মেধা ও মননের মেরুদণ্ডটি ভেঙে দেয়া যাবে।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা নেতৃত্ব দিলেও নিকট অতীতে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা নেতৃত্ব দিতে পেরেছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই, দরকার নেই বিস্তৃত মূল্যায়নেরও। এটা সর্বজন স্বীকৃত, অতীতে মেধার যে জায়গাটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছে, তার অবক্ষয় হয়েছে, সেটি ম্লান হয়েছে। কতখানি ম্লান হয়েছে সেটি, কতটুকু অবক্ষয় ঘটেছে সেখানে তা পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অবক্ষয় যে সেখানে ঘটেছে এবং গ্লানিমা যে সেখানে গেড়ে বসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নিকট অতীতে মেধা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে গেল, তার দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কতগুলো সর্বজনীন সামগ্রিক সমস্যা তৈরি হয়েছে, যেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। আর অন্যটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে, যার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা নেতৃত্ব দেয়ার জায়গায় পিছিয়ে গেছে।
উচ্চ শিক্ষার সামগ্রিক সমস্যাগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে পাঁচটি সমস্যা আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এক. আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য যে কী সেটা বোধহয় খুব সংহত ও পরিষ্কারভাবে আমরা এখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। উচ্চ শিক্ষার জন্য যিনি আসেন, তার কাছে হয়তো একটি সনদপ্রাপ্তিই মূল কথা। একটি সনদ পেলেই তিনি একটি ভালো চাকরি পাবেন—এমনটাই তার হয়তো ধারণা। উচ্চ শিক্ষা যারা দিচ্ছেন, তারাও হয়তো ভাবেন যে সনদ প্রদান করতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা কি অধিকার, নাকি এটা একটা সুযোগ, সে প্রশ্নেও একটা ধোঁয়াটে ভাব আছে। সুতরাং বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী, সে ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত।
দুই. রাষ্ট্রের দিক থেকেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো পরিষ্কার দিকদর্শন নেই। এই যে রাষ্ট্র উচ্চ শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে, কেন সে সেটা করছে, কী তার প্রত্যাশা, কী সে চায় উচ্চ শিক্ষা খাত থেকে, উচ্চ শিক্ষা রাষ্ট্রকে কী দিতে পারে তার খুব স্বচ্ছ সংহত কোনো ব্যাখ্যা নেই। বাংলাদেশে এ জাতীয় একটি ব্যাখ্যার অনুপস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষা খাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তিন. উচ্চ শিক্ষার পরিবেশের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। এ ব্যাপারে আমি শুধু শ্রেণীকক্ষের ভেতরের পরিবেশের কথা বলছি না, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামোর কথা বলছি। একটি পঞ্চতল ইমারতে ‘শিশু শিক্ষাসদন’ বসতে পারে, কিন্তু সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন একটি ভৌত অবকাঠামোর পরিবেশ থাকতে হবে, যেখানে শ্রেণীবহির্ভূত যেসব কার্যকর্ম থাকতে হবে এবং যা চলতে পারে তার ব্যবস্থার সুযোগ যেন থাকে।
চার. উচ্চ শিক্ষার একটি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। আমি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—এ বিভাজনের কথা বলছি না। আমি মনে করি, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেয়া-নেয়া, দাতা-গ্রহীতা বড় হওয়ার কারণে উচ্চ শিক্ষা একটি বাণিজ্যিক সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। ফলে সময়, সনদ এগুলোই বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং জ্ঞানার্জন, কী শিখছি তা গৌণ হয়ে গেছে।
পাঁচ. শুধু বাণিজ্যিকীকরণ নয়, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় এক ধরনের অশুভ রাজনৈতিকীকরণও ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি মদদপুষ্ট ছাত্রগোষ্ঠীগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু শিক্ষার পরিবেশই নষ্ট করেনি, সাধারণ ছাত্রদের জন্য তারা একটি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল।
শিক্ষকদের রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-নিয়োগ, পদোন্নতি, উচ্চ শিক্ষা সব বিষয়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ধারিত হয়েছে। ফলে মেধা নয়, মধ্যম মান পুরো ব্যবস্থার নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সবসময়ই রাজনীতি ছিল এবং সবসময়ই রাজনীতি থাকবে। কিন্তু তা হবে শুভ, সুস্থ এবং গঠনমূলক। দেশ গঠনে, সমাজ পরিবর্তনে, গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল বিনির্মাণে এ রাজনীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি ছিল বলেই এ দেশে গণ-আন্দোলন হয়েছে, জনযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম এগিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার এ সামগ্রিক চালচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অন্তরায়গুলোর দিকে তাকাই তাহলে আবারো পাঁচটি বিষয়ের দিকে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমত. ১৯৭৩ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ গৃহীত হয়, তখন তার একটি প্রেক্ষিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, দেশের উচ্চ শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে এটি একটি স্বাধীনতা ভোগ করবে, স্বাধীনভাবে এর কার্যকলাপ চালাতে পারবে, এটি একটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রভূমি হবে, এমন একটি ভাবনা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু অনেকেই এখন মনে করছেন যে বর্তমান সময়ে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনেকাংশেই তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে এবং বলা হচ্ছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বহু সমস্যার সূত্র ওই অধ্যাদেশের মধ্যেই নিহিত।
এ কথা ঠিক কিংবা বেঠিক সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না, কিন্তু অধ্যাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন যখন উঠেছে এবং বিষয়টি যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখন তা খতিয়ে দেখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই এবং আমরা যদি আমাদের কাছে সৎ থাকি, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের রাজনীতিকরণ অনুপ্রবেশ করেছে। সে রাজনীতিকরণের একটি দিক হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি সব সময় ছিল. এবং সব সময়ই থাকবে এবং সেখানে ছাত্ররাজনীতি ছিল বলেই দেশ ও জাতি বহু কিছু লাভ করেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি আর ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি এক জিনিস নয়।
কিন্তু আজকে বহু ক্ষেত্রে ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিকে একাত্ম করে ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দেশের বৃহত্তর রাজনীতির নানা টানাপড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়ছে। এটা গেল একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রাক্তন শিক্ষক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলছি যে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি বিস্তার লাভ করার কারণে রাজনীতি নিয়ে শিক্ষকরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ায় যে মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আর দেয়া যাচ্ছে না। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
তৃতীয়ত, মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ও মধ্যম মানের শিক্ষক নিয়োগ ব্যাপারটির রাজনৈতিকীকরণের কারণে মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ যে বিঘ্নিত হচ্ছে, তা একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন বলছেন, তেমনি বাইরের মানুষজনও বলছেন। সুতরাং এ রাজনীতিকীকরণের একটি দিক হচ্ছে যে, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে আমরা মধ্যম মানের শিক্ষককে অগ্রাধিকার দিচ্ছি, মেধামানের শিক্ষক নয়। সত্যি কি মিথ্যা সেটা আমাদের দেখতে হবে।
চতুর্থ কথা হচ্ছে, মেধা তৈরির যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বড় কথা হচ্ছে, মেধা এমনি এমনি তৈরি হয় না। মেধা তৈরির জন্য একটি পরিবেশের প্রয়োজন হয়, একটি অঙ্গীকারের দরকার হয়, মেধা তৈরির জন্য সম্পদেরও প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কী অঙ্গীকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি, রাষ্ট্র কীভাবে দেখতে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের প্রশাসকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শত্রু হিসেবে দেখেছিল এবং সেভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কী চায়, প্রত্যাশা কী তাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তা ভেবে দেখতে হবে।
পঞ্চমত, আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভূতপূর্ব ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে একটি যান্ত্রিকতা ঢুকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক শুধু শ্রেণীকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে যারা আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, তারা বলতে পারবেন যে শ্রেণীকক্ষের বাইরে, জ্ঞানার্জন ছাড়িয়ে আমাদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের যে সম্পর্ক ছিল তা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। এ সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই।
আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যান্ত্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রকম কার্যসম্পর্ক চিহ্নিত না করেই প্রশ্ন তুলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বেড়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছয় বছরের ছাত্রজীবনে একটি মাত্র ছাত্র আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। আজ শোনা যাচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্নতা, এক জাতীয় নৈরাশ্য বিরাজ করছে। কিন্তু কেন? এ জিনিসটি দেখা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধা নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য সাতটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার।
প্রথমত, মেধা নেতৃত্ব দেয়ার শর্তগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূরণ করতে হবে। যেমন এক. বিশ্ববিদ্যালয়ের মনন, চিন্তাচেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তি একটি উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি বিশ্ববীক্ষণ এবং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। দুই. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মনন ও চিন্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করতে হবে এবং তাদের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আধার হতে হবে। তিন. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে মেধা নেতা তৈরি করতে হবে। চার. পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা শ্রেণীকক্ষের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, শ্রেণীকক্ষের বাইরে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে জ্ঞান রয়েছে তা জানতে হবে। পাঁচ. দেশ, জাতি এবং জীবনের বহু ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবদান রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কী চায়, রাষ্ট্রই বা উচ্চ শিক্ষার ভূমিকা কীভাবে দেখে তা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই প্রত্যাশা কী তারও পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং শিক্ষকদের ভূমিকাও এক্ষেত্রে পরিস্ফুট হতে হবে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিকীরণের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মেধাভিত্তিক একটি কাঠামো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলতে হবে এবং মেধার ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। সেটা যেমন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে করতে হবে তেমনি শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও করতে হবে।
চতুর্থত. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একদিকে যেমন সম্পদ লভ্য করে দিতে হবে, তেমনি যথাযথ পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। আমি যখন পরিবেশের কথা বলছি, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হবেন না, তাদের অমানবিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে হবে না, তাদেরকে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে দিনের পর দিন একটি ছাত্রাবাসের বারান্দায় থেকে অতি শীতের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হবে?
পঞ্চমত, আমার মনে হয় যে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি আমরা নতুন করে ভেবে দেখতে পারি। এর অনেক সুফল আমরা ভোগ করেছি, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কুফলও হয়তো আছে। সুতরাং পুরো বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
ষষ্ঠত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাক্তন ছাত্র আজ পৃথিবীর নানা জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ছড়িয়ে আছেন। বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের পুরনো বা ভূতপূর্ব ছাত্রদের সঙ্গে একটি সংযোগ রক্ষা করতে চায় এবং তা শুধু একটি সমিতির মাধ্যমে নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা প্রাক্তন ছাত্র তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সমস্যাগুলো উত্তরণে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেই যোগাযোগটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
শেষত, ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ বছর হলো। ১৯২১ সাল আর ২০২৪ সাল এক নয়। এ দীর্ঘ পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পরিবর্তন-বিবর্তন হয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা পরিবর্তন হয়েছে।
১০৩ বছর পর একটা সময় এসেছে যখন একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করা হোক না কেন। সেই কমিশনের কাজ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ বছরের অর্জনকে তুলে ধরা এবং সেই সঙ্গে তার ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করা। সেই কমিশনের কাজ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ বছর পূর্তির সীমারেখায় দাঁড়িয়ে দেশ এবং জাতিকে বলা যে আগামী ১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় যেতে পারে, কী করে যেতে পারে, কী করা দরকার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নানা দিক বিবেচনা করে মেধা নেতৃত্বের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী জাতীয় সংস্কার দরকার, তার জন্য একটি শ্বেতপত্র উপস্থাপন করতে পারে। আগামী দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকনির্দেশনার ভিত্তি হতে পারে সেই শ্বেতপত্রটি।
প্রত্যাশা করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নেতৃত্ব এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা নেতৃত্ব সুনিশ্চিত করার জন্য উপর্যুক্ত পরামর্শগুলোকে বিবেচনা করবেন।