ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ দরকার
Share on:
গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এ বছর বেশি না হলেও মৃত্যুহার বেশি। সুতরাং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমে আসছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এ বছর এখন পর্যন্ত একদিকে প্রচণ্ড তাপ, অন্যদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি।
এ রকম উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এডিস মশার ডিম ও প্রজনন খুব দ্রুত হয়। বৃষ্টি হচ্ছে, আবার গরম পড়ছে। কাজেই একদিকে মশা নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আমাদের জোর দিতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনের কর্মসূচি বন্ধ ছিল। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার সব রকম স্থানীয় সরকার ভেঙে দিয়েছে। বর্তমানে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, তাতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কোনো তৎপরতা এখনও দেখছি না। হয়তো তারা প্রশাসনিক ও আর্থিক হিসাবনিকাশ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে লক্ষ্য করার মতো কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না।
মশক নিধনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণ ও প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া। ওয়ার্ড কাউন্সিলগুলো এখনও ভেঙে দেওয়া হয়নি। বিগত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল এবং বর্তমানে পলাতক। তবে কেউ কেউ ইতোমধ্যে আটক হয়েছেন। বাকিরা ভয়ে কার্যালয়ে আসছেন না। কাজেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিচ্ছন্নতা অভিযান যদি পরিচালনা করা না যায়, তাহলে ইতোমধ্যে যতটুকু অর্জন ছিল, তাও ভেস্তে যাবে।
পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ; সবাইকে কাজ করতে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা শুনেছি, ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করেছে। চট্টগ্রামের ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু শোনা যায়নি। কাজেই এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে। যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছে, তারা কাজ করতে চায়। যাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তাদের স্বেচ্ছাসেবক বানিয়ে কর্মসূচি গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সিটি করপোরেশনে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা যদি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেন তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। বড় কথা, শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে। এটা তাদের জন্য সারাজীবনের সম্পদ হিসেবে থেকে যাবে। স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের প্রতিবেশীদের মধ্যেও এই প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা গড়ে দিতে সক্ষম হবে। তাদের মাধ্যমে অন্যান্য শিক্ষার্থীর মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করা দরকার।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় মেডিকেল কলেজে বিকেন্দ্রীকরণ করতেই হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রামে রয়েছে। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বান্থ্যকেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু শহরের মানুষের সেবা পেতে বিভিন্ন অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। হাসপাতালে লাইন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পুরো দিনের রোজগারের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য এটি বড় এক বিপদ। শহরে ভ্যান কিংবা মাইক্রোবাসের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ কর্মসূচি নিলেও কিছুটা উপকার পাওয়া যেত। যেমন শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করবে, সেখানে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকবে। সরকারি মেডিকেলে গিয়ে রক্তের পরীক্ষা করা হবে। অন্তত যে ব্যক্তির ডেঙ্গু শনাক্ত হবে তিনি সাবধান হয়ে যাবেন। গ্রামীণ পর্যায়ে যে এডিস মশার জরিপ হতো, সেটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর স্থানীয় সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন লোক আসছে এবং প্রশাসনে রদবদল হচ্ছে। এই জরিপ সারাবছর দরকার। তিন বছর হওয়ার কথা ছিল। এক বছর হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। গ্রাম কিংবা শহরের যেসব অঞ্চলে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, সেখানকার প্রাথমিক চিকিৎসা কমপ্লেক্সে মশক নিধনের যাবতীয় যন্ত্রপাতি থাকা দরকার। এখানে জনগণ নামমাত্র দামে কিংবা বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রাথমিক সেবা পাবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের কাজ হলো, ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও এখনও অবস্থা জটিল নয়, এমন আক্রান্তদের হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, প্রবীণ ব্যক্তি কিংবা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের এই আওতায় ভাবা যেতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ের ডেঙ্গু আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না। শুধু মুমূর্ষু ও জটিল রোগীদেরই হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে।
শহরে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি হাসপাতাল থাকতে হবে। গ্রামে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের হাসপাতাল রয়েছে। ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশন হাসপাতাল বা রেলওয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থা আছে। এসব হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তদের পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে। এ ধরনের মাধ্যমিক হাসপাতালের সুবিধা হলো, জটিল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া। আক্রান্তদের পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে অ্যাম্বুলেন্সে মেডিকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা নেবে। এভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় পর্যায়ে ভাগ করে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে রোগীর মৃত্যুহার কমে যাবে। ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হলে আমাদের এ ধরনের একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ দরকার। এ কথা আমরা বহুবার সংবাদমাধ্যমে বলেছি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা আমি জানি না। চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করলে রোগীর মৃত্যুহার কমে যাবে। যেভাবে মৃত্যুহার বাড়ছে তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যেসব রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক, সেগুলো শুধু হাসপাতাল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এখানে দরকার জনস্বাস্থ্য বা কমিউনিটিভিত্তিক স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা। একক রোগীভিত্তিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে, কিন্তু সামষ্টিকভাবে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন মশারি ব্যবহার, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেতনতা বাড়ানো, সাইকেল লেন ও পার্কের ব্যবস্থা, মানুষের হাঁটার সুযোগ নিশ্চিত করা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এগুলো করতে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু অর্থ খরচ হবে, কিন্তু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে গেলে বিপুল অর্থের অপচয় ঠেকানো যাবে।
বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি চিকিৎসাক্ষেত্রের ৬০ শতাংশ ওষুধের পেছনে খরচ করেন। এ পরিস্থিতি পাল্টাতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে এ অবস্থা বদলানো সম্ভব। আমাদের একটি সুস্থ জাতি গড়ে তুলতে হবে। এতে আর্থিক অপচয় অনেক কমে আসবে। সেটা জনস্বাস্থ্যভিত্তিক চিকিৎসা সেবার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু টাকা খরচ হয়, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে সেটি সম্পদে পরিণত হয়। এভাবে জনস্বাস্থ্যভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ডেঙ্গু সমস্যার নিরসন সম্ভব। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের সংস্কারে স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমলে নেবে।