মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৯, সেপ্টেম্বর ২০২৪

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চাই ‘তরুণ নেতৃত্ব’

Share on:

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশা, জীবনবোধ ও জীবনীশক্তি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সব নাগরিকের জন্য যেসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, সেগুলোর মধ্যে আছে বৈষম্যমুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান‍।


আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রতি তৎকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ না থাকায় ওই অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেশকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন-বৈষম্য-বঞ্চনার অবাধ রাজ্যে পরিণত করে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্ভীক তরুণরা বৈষম্যহীন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে নেতৃত্বের হাল ধরার বিষয়ে অগ্রজ প্রজন্মের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে অনেক শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক আত্মাহুতি দিয়েছে। অসংখ্য আহত মানুষ এখনও বেঁচে থাকার কাতর আকুতিতে হাহাকার করছে। ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য কেন এত সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোর, তরুণ ও যুবককে অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে? কেন এত আহত মানুষকে যন্ত্রণায় কাতরাতে হবে?

সতেজ প্রাণের সমন্বয়

নবীন-তরুণ ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তিতে ন্যায়বিচারপূর্ণ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যপথে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা এই তরুণ ছাত্রসমাজ ধারণ ও লালন করে। রাষ্ট্রের সংস্কার বাস্তবায়ন করে ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গঠনের ভিত্তিতে সর্বস্তরের জনগণের জন্য নিরাপদ জীবিকা ও আত্মবিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার নতুন লক্ষ্যে তরুণ ও প্রবীণদের নজিরবিহীন ঐক্য আমরা দেখতে পেয়েছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা যথার্থ অর্জনের লক্ষ্যে বাস্তবানুগ রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ পেশাদারী অভিজ্ঞতা, নবাগত সতেজ প্রাণ তরুণ জীবনীশক্তির সমন্বয় এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক সম্মিলিত পদক্ষেপ।

তরুণ প্রজন্মের জীবনবোধ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনসংখ্যাবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নবীন ও তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৮.৬৭ শতাংশ এবং ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীর সংখ্যা ২২.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে নবীন, তরুণ ও যুবার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০.৯৫ শতাংশ। দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই বিপুলসংখ্যক নবীন, তরুণ ও যুবশক্তির ওপরে। আমাদের দেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেতৃত্বদানের অন্যতম চাবিকাঠি হতে পারে তরুণ প্রজন্মের জীবনবোধ, জীবনীশক্তি এবং প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি জনগোষ্ঠীর বয়স যেহেতু ২৫ বছরের নিচে, সেহেতু দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্রসমাজের প্রত্যাশা, জীবনবোধ এবং জীবনীশক্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা অবশ্যই জাতীয় কর্তব্য।

বর্তমানে অনেক তরুণ প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষুদ্র উদ্যোগ, অনলাইন বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবন ও সৃজনশীল উদ্যোগকে যথাযথ আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক সহায়তা দিতে হবে।

জনসংখ্যাজনিত লভ্যাংশ

কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যার তুলনায় বেশি হয়, জনসংখ্যার সেই বিন্যাসকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা ‘জনসংখ্যাজনিত লভ্যাংশ’ বলা হয়। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী দেশে ১৫-৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ১১ কোটি ৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৫.২৩ শতাংশ। এই কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মধ্যে রয়েছে মোট জনসংখ্যার ৩২.৮৪ শতাংশ তরুণ, যার অর্থ বর্তমানে বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর লভ্যাংশের সুফল ধারণ করছে।

রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে নবীন ও তরুণ প্রজন্মকে আগামী দিনের নেতৃত্বের হাল ধরার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে আগামীতে বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রযুক্তি। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খেতে সক্ষম সৃজনশীল মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া আবশ্যক।

পৃথিবীকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর উপযুক্ত অবস্থায় রাখার দায়বদ্ধতা থেকেই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্ম। তাই একদিকে যেমন সবার জন্য উৎপাদন ও ভোগের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তেমনি অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পিত ও না হলেই নয় এমন ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবী গ্রহের ক্ষতিসাধন রোধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা যাবে না।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যোগ্য নেতৃত্বের গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। এ লক্ষ্যে তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়ন আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।

দৈনিক সমকাল