জুয়াড়িনির্ভর পুঁজিবাজারের লাগাম টানবে কে?
Share on:
আওয়ামী লীগের শাসনের ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজার যে অচল হয়ে গিয়েছিল, তা নয় বরং তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। এর জন্য প্রধান দায়ী বলা যায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
তারা জুয়াড়িনির্ভর একটি পুঁজিবাজারের সৃষ্টি করেছিল। দরপতনের কারণে ৭ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গিয়েছিল সূচক। পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি থাকার কথা না সেগুলোকে সেখানে আনা হয়েছিল। পুঁজিবাজারে আধিপত্য ছিল জাংক স্টকের। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কতগুলো খারাপ উদ্যোক্তা। গত দু-তিন বছরে কোনো ভালো শেয়ারের দাম বাড়েনি। কারসাজির মাধ্যমে খারাপ শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
যেখানে যেসব সংস্কার দরকার ছিল বিএসইসি সেখানে সেটা করেনি। তারা করেছে পাম্পিং ও ডাম্পিং। পুঁজিবাজারে মাফিয়া গ্রুপ কাজ করেছে। সেখান থেকে অনেকেই অনেক টাকা নিয়ে গেছে। পরে দেখা গেছে, তারা যে উদ্দেশ্যে টাকা নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কোনো সঠিক উদ্দেশ্য ছিল না। কিছু কোম্পানিকে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে পুঁজিবাজারে আনা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এগুলো চলার মতো কোনো কোম্পানি ছিল না।
একসময় ৩৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনারস (বিও) অ্যাকাউন্টধারী ছিল। কমতে কমতে ১৫ লাখে এসে ঠেকে। এরপর ১৩ লাখে আসার পর গত জানুয়ারিতে হাজার হাজার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কতটা হতাশা হতে পারে? ২০২২ সালের জুলাইয়ে শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দরসীমা) চালু করা হলো। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কৃত্রিমভাবে দর চালু করে। এটি চালুর পর দেখা গেল, পুঁজিবাজারে ৮০ শতাংশ বেচাকেনা হয় না এবং ২০ শতাংশ নিয়ে জুয়া খেলা হয়। ১৭ শতাংশ হিসেবে বেকিং দিচ্ছে মার্জিন লোন। আবার ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হলো, তখন মার্জিন লোনের কারণে নেতিবাচক পর্যায়ে চলে এল। ফলে তারা তাদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিল। এভাবে দেশের পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাজারে প্রকৃত বিনিয়োগকারী মাত্র ১০ শতাংশ। তারা বলে যে আমরা কেন বিনিয়োগ করব? ভালো কোম্পানিকে যখন বলা হলো বিনিয়োগ করতে, তখন তারা বলে শেয়ারের দাম বাড়বে না। তারা বিনিয়োগে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। কেননা বাজারের সামগ্রিক টার্নওভারের ৯০ শতাংশই আসত জুয়া খেলা থেকে। এটা আসলে প্রকৃতপক্ষে কোনো পুঁজিবাজার নয়। প্রকৃত পুঁজিবাজারে ৮০ শতাংশ প্রকৃত বিনিয়োগকারী থাকবে। বাকি ১০-২০ শতাংশ জুয়াড়ি হতে পারে। প্রকৃত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ সময় বিনিয়োগ করবে এবং কোম্পানির ভিত্তি দেখা হবে। কিন্তু পুঁজিবাজারে কোম্পানির ভিত্তি শক্তিশালী নাকি দুর্বল তা দেখার মতো কোনো লোক ছিল না। শেয়ারবাজারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো পিএলসি (বিএটি) ও গ্রামীণফোনের শেয়ার দাম কমতে কমতে এমন এক জায়গায় আসে, তখন প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে গেলেন। আর জুয়াড়িরা খুশি হলো। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার কারণে পুরো সিস্টেমে তারল্য শূন্যতা দেখা দেয়। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) দেউলিয়া হয়ে গেল। যদিও প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের দোষের কারণে দেউলিয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আইসিবির কোনো ক্ষমতা নেই। যখন দেউলিয়া হয়ে গেল তখন সরকারের পক্ষ থেকে আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকা দেয়ার কথা শোনা গিয়েছিল। আমার মতে, প্রতিষ্ঠানটিকে যে পরিমাণ টাকা দেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে ভালো করতে পারত এবং সরকারকে রিটার্ন দিতে পারত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি কিংবা অন্যভাবে টাকা নষ্ট করেছে, যার কারণে আবার অর্থায়ন করতে হবে। এভাবে আসলে হয় না। এটা অনেকটা সোনালী, জনতা ও অগ্রণীর মতো রি-ক্যাপিটালাইজেশন করা। খারাপ লোনের মাধ্যমে মূলধন নষ্ট করার পর তারা অর্থ দাবি করলে সরকার তা দেয়। বাজেট প্রভিশনের মাধ্যমে দিয়েছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। ফলে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না।
ট্রেজারি বন্ডে ও ট্রেজারি বিলের সুদের হার অনেক বেড়ে গেল, যা সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য। ফলে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ বের হয়েছে। যারা বড় বিনিয়োগকারী তারা পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে সেখানে (ট্রেজারি বন্ড ও বিলে) বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে টাকা প্রবেশ করেনি। সবকিছু মিলিয়ে পুঁজিবাজার হয়ে গেল প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরুৎসাহিত জায়গা। অথচ এক বছরে পাকিস্তানের পুঁজিবাজার হয়ে গেল দ্বিগুণ। ভারতের পুঁজিবাজার অনেক ভালো করল, তারা রেকর্ডের পর রেকর্ড করছে। আর বাংলাদেশ পুঁজিবাজারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নেমে গেল।
সুদের হার বৃদ্ধি, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী ও উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর এত দ্রুত অবনতি ঘটেছে যে এর প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। প্রকৃতপক্ষে শেয়ারের দাম যত থাকা দরকার তার চেয়ে ৪০ শতাংশ নিম্ন দামে শেয়ার বেচাকেনা হয়েছে। গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ৫৫০ থেকে নেমে ২৫০-এ এসেছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের দাম ৮০০ থেকে নেমে ৩১৮ টাকা হয়েছে। এটি বিনিয়োগের জন্য ভালো সুযোগ। তার পরও কোনো ক্রেতা নেই।
গত ৫ আগস্ট দেশে স্বৈরশাসকের অবসান হয়েছে। এর দুদিন পর পুঁজিবাজার ভালো করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে বলে আশা রাখি। যারা মার্জিনে ছিল, তারাও এগিয়ে এল। নতুন বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। যার কারণে গত বৃহস্পতিবার একদিনে শেয়ারবাজারের সার্বিক সূচক ৩০৬ পয়েন্ট বাড়তে দেখেছি। গত মঙ্গল ও বুধবারও বেড়েছে। এটি শেয়ারবাজারে রেকর্ড।
আমি মনে করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ায় দেশের অর্থনীতি ভালো হবে। কারণ আগের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আসবে না। হরতাল, ধর্মঘট হবে না। গণতন্ত্র ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের আশা দেখছি। দেশের বিচার বিভাগ ঠিকমতো কাজ করবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হবে। দেশের পুলিশের মধ্যে সংস্কার হবে। সবকিছু ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।
দেশে শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে সব খাতেই একটি সংস্কার হবে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আগের মতো সাড়ে ৭ শতাংশে নাও যেতে পারে। এখন এটা এত নিচে নেমে গেছে, এটাকে ঘুরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে।
অবশেষে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটবে। ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান হয়েছে, এটার প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে। এখন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ছে, ভোগও বাড়বে। আগের মতো একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ যারা সরকারকে শুধু তেলবাজি করবে, সেটা এখন হবে না। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানকে ব্যবসায়ী গ্রুপ শুধু প্রশংসা করবে, তিনি সেটা পছন্দ করবেন না। সবকিছু মিলিয়ে আমি ইতিবাচক দেখছি। এরা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে পাস করার মতো কেউ নেই দেশে। তারা ব্যর্থ হবেন না বলেই আমি আশাবাদী। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের ফলে দেশ অনেক বড় বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে। এখন সংস্কারের জন্য সবাইকে একটু ধৈর্য ধরা দরকার। ভালো ফল পেতে এ সরকারকে সময় দেয়া দরকার।
অনেক ভালো কোম্পানি রয়েছে, যারা এখনো পুঁজিবাজারের তালিকায় আসেনি। অভ্যন্তরীণ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকায় আনার জন্য সরকারকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখা দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে হবে এবং তাতে সরকারের আয় বাড়বে। আশা করি, ঘাটতি বাজেটও কমে যাবে। আর ঘাটতি বাজেট যদি সরকার কমাতে পারে, তাহলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থপ্রবাহ বাড়বে।
পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে সময় লাগবে। এখন সুশাসন কায়েম করতে হবে। মানুষের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে হবে। পুঁজিবাজারকে বিনিয়োগ উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। কেননা ১৫ বছর আগের পুঁজিবাজারের চেয়ে অনেক পেছনে চলে গেছে। সে সময় পুঁজিবাজারের টার্নওভার থাকত প্রায় ২ হাজার কিংবা ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অথচ এখন গড়ে টার্নওভার মাত্র ৪০০ বা ৫০০ কোটি টাকা। টার্নওভার এখন আগের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ কমে গেছে।
পুঁজিবাজারে ৫০-৬০টি কোম্পানি ভালো আছে। দেশে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশী কোনো কোম্পানি আপাতত সেখানে নেই। তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে হলে স্থিতিশীল বিনিময় হার প্রয়োজন। পুঁজিবাজারে যদি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে দ্রুতই ভালো করা সম্ভব।