মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ২০, সেপ্টেম্বর ২০২৪

জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশের বিপর্যয়, মারাত্মক ঝুঁকির দিকে দেশ!

Share on:

পৃথিবীতে বর্তমানে ৮০০ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এর অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী মরুময়তা, খরার ঊষ্ণতা, দাবদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধরাবাহিকতায় পৃথিবী ধীরে ধীরে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। ক্ষয়, ক্ষরা, মরুময়তার কারণে জীববৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।


বিশ্বে বিগত ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪০ বছরে বায়ু দূষণে সাড়ে ১৩ কোটি মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। তন্মধ্যে এশিয়ার চার দেশেই মৃত্যু হয়েছে ৫০ লাখ। বিশ্ব সংস্থার মতে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই বিশ্বে প্রতি বছর প্রাণ হারান ৬৭ লাখ মানুষ। পরিবেশবাদীদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করার কাক্সিক্ষত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলে ২০৪৫ সালের মধ্যে দুনিয়ার ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ খরার কারণে উদ্বাস্তু হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

উন্নত পরিবেশ সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত। পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হতে পারে না। পৃথিবীর প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমি সংরক্ষণে ভূমি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশ বিষয়ে জাতিসংঘ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনের স্মরণে প্রতিবছর ৫ জুন দুনিয়ব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন করা হয়। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ ও জাতীয় উন্নয়ন রুপকল্প -২০৪১ এর সাথে সঙ্গতি রেখে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিঘাতে সৃষ্ট বিপন্নতা ও ঝুঁকি নিরসনের মাধ্যমে একটি জলবায়ু অভিঘাত সহিষ্ণু সমাজ গঠন করার চেষ্টা চলছে বাংলাদেশে। গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির এ বছর ২০২৪ সালে পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Land restoration, desertification and drought Resilience’ যার অনুবাদ করা হয়েছে, “করবো ভূমি পুনরুদ্ধার ও রুখবো মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। এছাড়া এ বছরের জন্য শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “Generation Restoration.” সারা বিশে^র প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা আজ ভূমির অবক্ষয়জনিত কারণে ক্ষতির সম্মুখীন। সে আলোকে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ও শ্লোগান নির্ধারণ যথাযথ হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

২০২৪ সালে ৫ জুন বিশ^ পরিবেশ দিবসে ঢাকার বাতাস ৯ গুণ দূষিত ছিল। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার এর তথ্য মতে এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা ছিল বিশে^র ১১৭ টি বড় শহরের মধ্যে অষ্টম দূষিত বায়ুর শহর। এমতাবস্থায় পরিবেশ দূষণরোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশ নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে গত ৫ জুন ‘বিশ্ব’ পরিবেশ দিবস ২০২৪” পালন করেছে।

উন্নয়নের নামে গত ২০২৩-২৪ সালের এর এক বছরে সারা দেশে ১১ লাখ বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে। প্রতিমাসে গড়ে গাছ কাটা পড়েছে ৮৮ হাজার ১৯০ টি গাছ। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রামে। গাছ কাটায় এগিয়ে স্থানীয় সরকার ও বনবিভাগ। দেশের শহরগুলোর পাশের আবাদী জমিগুলোতে অপরিকল্পিত বাসতবাড়ি, দালানকোঠা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত নির্মাণের ফলে একদিকে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে আবাদী জমি হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বহুবছরের পুরোনো পুকুর ও সানবাঁধা গভীর কূপগুলো ভরাটের মহরার কারণে বর্তমানে আকস্মিক অগ্নিকান্ডে আগুন নিভানোর মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে ইটের ভাটার সংখ্যা এখন বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রায় সাত হাজার ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিচালিত ভ্যাম্যমাণ আদালত ও অন্যান্য আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে ১১৮০টি অর্ধেক ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করাসহ ১১১.৫৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ / জরিমানা আরোপ করা হয়েছে।

নির্মাণে পরিবেশ সুরক্ষায় উচ্চ আদালত থেকে একের পর এক নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসিনতা ও সমন্বয়হীনতায় উপেক্ষিত থাকছে এসব রায় ও আদেশ। কয়েকটি ঘটনায় অন্তত ৬০ সরকারী কর্মকর্তার নামে দায়ের করা হয়েছে আদালত অবমাননার মামলা। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট প্রভাবশালীদের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চআদালত এর নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না বলে অনেকেরই অভিযোগ আছে। এভাবে পাহাড় কাটা, নদী দখল, পুকুর জলাশয় ভরাট কওে ভবন নির্মাণ, ঝড়, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মরুময়তা, নদীর নব্যতা হারানো ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশ এক মারাত্মক পরিবেশ ঝুঁকি দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ইউনেস্কার বিশ^ ঐতিহ্যেও তালিকাভুক্ত, বিশে^র সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন পড়েছে অগ্নিঝুঁর মুখে। গবেষণা সূত্রে প্রকাশ, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল নাগাদ সুন্দর বনের বাংলাদেশ অংশে অন্তত ২৪ বার অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ৪ মে ২০২৪ সালে এ বনের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুনে প্রায় ৮ একর ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি সাধন হয়। সুন্দরবন এখন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে অসুন্দরের দিকে ধাপিত হচ্ছে। একে বাঁচানোর আশু পদক্ষেপ খুবই জরুরি।

পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে অর্থ ও দক্ষতা উভয়ই দরকার। জীবন-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, জলাভূমি, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত,বন ও বন্যপ্রাণির নিরাপত্তা বিধান করতে হলে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অতীব জরুরি বিষয়। বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের ব্যবহারে শিশুদের ওপর স্ক্রিন টাইমের প্রভাবে বিলম্বিত ভাষার বিকাশ, সামাজিক মিথক্রিয়া হ্রাস এবং শিশুদেও মধ্যে ঘুমের ধরন মারাত্মকভাবে ব্যহত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করার মতো। অতিশীত, অতি খরা, অতি দাবদাহ ইত্যাদি কারণে বজ্রপাতে দেশে প্রতি বছর অগণিত মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। দেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যহারের মাত্রা এতই বেড়েছে যে, এটার আর কোন বিকল্প নেই বলে প্রতিয়মান হবার মতো অবস্থা। মাঝে মাঝে এ বিষয়ে মৃগি রোগীর মতো ঝাঁকুনি দেয় সরকার, স্যান্ডেল শুকাবার পর রোগীর খিঁচুনি ভালো হয়ে গেলে যেই সেই অবস্থা।

গত ২০২৪ সালের ২৯ মার্চে প্রকাশিত প্রথম আলো পত্রিকার এক রিপের্টে জানা যায়,সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ‘বৈশি^ক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩’ প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশে^র দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা। প্রতিবেদনে জানা যায়, বায়ুদূষণ, অনিরাপদ পানি, নিন্মমানের পয়োনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধি, আর্সেনিক এবং সিসাদূষণে অন্তত ২লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এসব দূষণের ফলে বছরে দেশের মানুষের ৫২২ কোটি দিন অসুস্থতায় অতিবাহিত হয়।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ উদ্বেগজনক মাত্রার দূষণ ও পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এটা তুলনামূলক বেশি ক্ষতি করছে দরিদ্র, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক ও নারীদের। নীতি ও সময়ানুগ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে এর মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

প্রতিবেদনে বলা হয়,পরিবেশ দূষণ শিশুদের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।সিসার বিষক্রিয়া শিশূদের মস্তিষ্কের বিকাশে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে বছরে প্রাক্কলিত আইকিউ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন পয়েন্ট। গৃহস্থালিতে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে রান্না বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস এবং তা নারী ও শিশুদের বেশি ক্ষতি করছে। শিল্পের বর্জ্য, অনিয়ন্ত্রিত প্লাষ্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা অপরিশোধিত ময়লাযুক্ত পানির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির গুণগতমান মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয় , দেশে ২০২২ সালে পরিবেশ ধূষণে ৪০ হাজার শিল্প কারখানা এবং ৫ লাখ ৮০ হাজার যানবাহন ছিল। এ সব কারখানার বর্জ্য এবং পরিবহনের নির্গত ধোঁয়া দূষণ একটা বড় ফ্যাক্টর। ২০২১-২২ সালে দেশে প্রায় দু’হাজার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়, এতে দু’হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশগত ক্ষতির জন্য জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবেই আমরা মানুষের সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন নিশ্চিত করার জন্য দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের নানা ধরনের সমস্যা আছে। মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সমস্যা নিরসনে অর্থ ও দক্ষতা উভয়েরই দরকার।’ তিনি বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে অসহায়ত্ব শিকার করে উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের জলবায়ু খাতে যে অর্থায়ন হয়েছে, তার ৪০ শতাংশ এসেছে ঋণ হিসেবে। বড় বড় দেশ যারা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তাদের কোন দায় নেই, কিন্তু দায়টা আমাদের নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের হয় অ নুদান দিতে হবে কিংবা সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।

আধুনিকায়ন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। একই সাথে এসব উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে পরিবেশের উপর একটি বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ বিপর্যয়ে জননিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি সব বিষয়ের উপর বিরুপ প্রভাব বিস্তার করে মানব জীবনের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা নানা ভাবে বাঁধাগ্রস্ত করে। পাশাপাশি আমাদের পার্শ্ববর্তী বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত কর্তৃক টিপাইমুখ, ফারাক্কা, গজলডুবি বাঁধসহ ৫২ টি বাঁধ বিগত ৫৩ বছরে মরুময়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে ৩১২ টি নদ-নদীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি নদী বিদ্যমান থাকলেও নব্য হারানোর ফলে ৯ মাস থাকে বালুচর আর তিনমাস থাকে ভয়াবহ বন্যা প্রকোপ।

সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ, রান্নায় সবুজ জ¦ালানির ব্যবহার এবং শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য ও পানীয় দূষণ রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ কওে বায়ু দূষণ কমাতে হবে। প্রতিবেদনের সহপ্রণেতা আনা লুইসা গোমেজ লিমা বলেন, সময়োচিত এবং সঠিক নীতি ও কার্যক্রমের মাধমে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের ধারা পাল্টে ফেলতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা জোরদারে পদক্ষেপ এবং রান্নার সবুজ জ¦ালানির জন্য বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি দূষণ কমাতে পারে। তিনি আরও বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা, অপযাপ্ত বাজেট, আমলাতন্ত্র এবং গবেষণা পরিবীক্ষণ জনসম্পৃক্ততা, স্বচ্ছতা ও আইন প্রয়োগের সমস্যা।

২৮ মার্চ এএফপি, রয়টার্স এর এক প্রতিবেনে জানা যায় বিশ্বজুড়ে ২০২২ সালে ১০০ কোটি টনের বেশি খাবার নষ্ট হয়। জাতিসংঘের ফুট ওয়েস্ট ইনডেক্স শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ও প্রায় ৮০ কোটি মানুষ যখন না খেয়ে আছে, তখন লাখ কোটি ডলার মূল্যের খাবার অপচয় হচ্ছে, যা বিশ্ববাজারে আসা উৎপাদিত খাদ্য দ্রব্যের প্রায় এক পঞ্চমাংশ। এ ধরনের অপচয়ের ঘটনা নৈতিক নয়; বরং পরিবেশগত ব্যর্থতা।

‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রমেন্ট অ্যানালাইসিস ২০২৩’ নামের প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণসহ তিন ধরনের পরিবেশ দূষণে প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ৃ দূষণের কারণে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণে মৃত্যু হয়েছে ১,৪৯,২৯৪ জন, পানি স্যানিটেশন ও আর্সেনিকের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে, ৬৪, ৭০৮ জন এবং সিসার দূষণে মৃত্যু হয়েছে ৫৯, ৪৯২ জনের। যে কারণে সে বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের(জিডিপি) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত মোকাবেলা ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে আমি সর্বপ্রথম বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র উদ্যোগে গত ১৯-২১ ডিসেম্বর ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ পরিবেশ সম্মেলন (আইসিবিইএন-২০০২) ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করি। সকাল ১০ টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনের পর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা বহুবিধ উপাদান সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈজ্ঞানিক অধিবেশন, সাধারণ অধিবেশন, প্লেনারী, বিতর্ক, পরিবেশ বিষয়ক সাধারণ প্রদর্শনী, আলোকচিত্র ও চিত্রকর্ম প্রতিযোগিতা এবং প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রামান্য চিত্র প্রদর্শন, র‌্যালি আলোচনা সভা ইত্যাদি ছিল সে সম্মেলনের কর্মসূচী।

সে সম্মেলনে বহি:বিশ্ব ও দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে পরিবেশবাদীরা এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নকামী অসংখ্য পরিবেশবাদী বিশেষত: বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, শিক্ষক, অর্থনীতি ও পরিকল্পনাবিদ, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানী, আইনবিদ, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, তথ্যকর্মী, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, মাটি-পানি-বায়ু-খনি-জ¦ালানি-আবহাওয়া-বৃক্ষ-পাখি বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, জিও, এনজিও, সরকারী- বেসরকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশন ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান সদস্য, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশিষ্ট শিক্ষার্থীবৃন্দ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মীগণ এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

সম্মেলনে সকলের মতামত, সুপারিশমালা, আলোচনা, পর্যালোচনা, করণীয়, বর্জনীয় বিষয়াদীসহ পরিবেশ সংরক্ষণে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন বিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে সকল প্রকার সহায়তা দানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এরপর ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও জামালপুর জেলায় পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। এরপর থেকে জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষরোপণসহ মজাপুকুর পরিষ্কার, সুবর্ণখালী, ঝিনাই ও করতোয়া নদীর জলাবদ্ধ কচুরীপানা পরিষ্কার করে বিভিন্নজাতের পোনামাছ অবমুক্ত করার মাধ্যমে মাছ চাষের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এছাড়া ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা’ ২০২৩ উপলক্ষে শ্লোগান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমি জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয়বারের মতো পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট, সনদ ও প্রাইজমানি গ্রহণ করি। ঢাকাস্থ শেরে বাংলা নগর, আগারগাঁও পরিবেশ অধিদফতরের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো: শাহাব উদ্দিন এমপি, প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, জয় কুমার ভৌমিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ। এ সব পুরস্কারের দায়বদ্ধতার কারনে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিষয়ক গবেষনা করে লেখালেখির পাশা পাশি মাঠ পর্যায়ে কাজ করার চেষ্টা করছি।

দৈনিক সংগ্রাম