জার্মানির রাজনীতিতে ভূমিকম্প, দৃশপটে আসছে ডানপন্থীরা
Share on:
গত তিন সপ্তাহে জার্মানির তিনটি রাজ্য পার্লামেন্টের নির্বাচন হলো। সর্বত্রই কট্টর ডানপন্থীদের রমরমা অবস্থা। বিষয়টি যেন জার্মানির রাজনীতিতে ভূমিকম্প।
গত তিন সপ্তাহে তিনটি রাজ্য পার্লামেন্টের নির্বাচনে কট্টরবাদীদের উত্থানের ফলে অভিবাসী শরণার্থী ও মুসলিমদের প্রতি তাদের সুর আরও কঠোর হয়ে উঠছে।
নির্বাচনের দিন জার্মানিতে বসবাসরত ছয়জন অভিবাসীকে নিয়ে দ্য জাইট পত্রিকা ২২ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উঠে এসেছে জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান কট্টরবাদীদের উত্থানের ফলে এ দেশে বসবাসকারী অভিবাসীদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা।
২২ সেপ্টেম্বর রাজধানী বার্লিনের সীমান্তে অবস্থিত ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যে নির্বাচনের আগে ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পূর্বাঞ্চলীয় দুটি রাজ্য থুরিঙ্গিয়া ও সাক্সেনে প্রাদেশিক পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটি রাজ্যেই হিটলারের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির (এনএসডিএপি) অনুসারী এএফডি বা জার্মানির জন্য বিকল্প দলটির বড় রকমের উত্থান ঘটেছে। দলটি থুরিঙ্গিয়া রাজ্যে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে শীর্ষ এবং সাক্সেন রাজ্যে ৩০ শতাংশ ও ব্র্যান্ডেনবার্গে ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান দখল করেছে।
দ্য জাইট পত্রিকার সেই সাক্ষাৎকারে মুনশেনগ্লাডবাখে বসবাসকারী একজন শ্রীলঙ্কান সমাজকর্মী, যিনি জার্মানিতে পড়াশোনা করে অভিবাসী ও শরণার্থীদের জন্য কাজ করেন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ‘যখন আমি দেখি, ডানপন্থী কট্টরবাদীদের মতামত মিডিয়ায় ক্রমেই উচ্চতর হয়ে উঠছে, কট্টরবাদী এএফডি বা জার্মানির জন্য বিকল্প দলটি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কেবলই অযৌক্তিকভাবে ঘৃণা ও উসকানি ছড়াচ্ছে, তখন বিষয়টি উদ্বেগজনক মনে করি। যে দেশে আমাকে অপমানিত ও অপমান করা হয়, সেখানে আমি কেন থাকব? আমি আগামী বছর আমার সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।’
দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর থেকে ১৯৮৯ সালে ইউরোপে এসেছিলেন ৬২ বছর বয়সের একজন শিল্পী—মার্সেলো মার্টিনেজ ভেগা। এখন থাকেন দক্ষিণ জার্মানির ফ্রাইবার্গ শহরে। তিনি বলেছেন, ‘জার্মানি এবং ইউরোপে এই ডানপন্থী, উগ্রবাদীদের কণ্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরেই তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর পপুলিজম রাজনীতিতে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয় না, তারা সমাজের হতাশা ও বঞ্চনার জন্য অভিবাসীরা দায়ী, সেই ট্যাগ লাগিয়ে জার্মানির কট্টরবাদী দলটি অনৈতিকভাবে রাজনীতি করছে।’
এ মুহূর্তে জার্মানির নব্য নাৎসি কট্টরবাদী দল এএফডি এবং যুব সংগঠন ‘ইয়ং অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বিভিন্ন রাজ্যে সহিংস দল হিসেবে জার্মানির সংবিধানিক সুরক্ষা বা সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। তবে তারা নিষিদ্ধ দল নয়।
গত মার্চ মাসে আদালত তাঁদের রায়ে বলেছেন, এএফডি দলটি নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা ও গণতন্ত্রের নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু অভিবাসন পটভূমিতে থাকা জার্মান নাগরিকদের বিষয়ে তাদের অবমূল্যায়িত রাজনীতি আইনবহির্ভূত। এ ধরনের বৈষম্যমূলক প্রচার–প্রচারণা ও রাজনীতি জার্মান সংবিধানের মৌলিক আইনে অনুমোদিত নয়। বিষয়টি মানবিক মানমর্যাদার গ্যারান্টির সঙ্গে বেমানান ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আদালত বলছে ‘জনগণের জাতিগত-সাংস্কৃতিক ধারণা’ বিষয়ে শরণার্থী, অভিবাসী ও মুসলমানদের প্রতি এএফডি দলটি অবজ্ঞা ও অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করছেন। আদালত বিষয়টিকে গণতন্ত্রবিরোধী প্রচেষ্টার ইঙ্গিতও রয়েছে বলে মনে করছেন।
জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই হিটলারের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আইন করে দলটি নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিকে অপরাধমূলক সংগঠন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ১৯৪৯ সালে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির প্রতিষ্ঠার পর হিটলারের নাৎসি দলটির প্রচার–প্রচারণা, লেখা শব্দ বা প্রতীকের মাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
আইন বা জেল–জরিমানার ভয় রইলেও জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দলের অনুসারীদের ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। বিশ্বযুদ্ধোত্তর নানা নামে নব্য নাৎসিরা সংগঠিত হয়ে বারবার জার্মানির রাজনীতিতে ঘুরেফিরে এসেছে। বর্তমানে নব্য নাৎসি এএফডি বা জার্মানির জন্য বিকল্প দলটি জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের মতো অবস্থানে না পৌঁছলেও প্রাদেশিক পার্লামেন্টের নির্বাচনে দলটির এই উত্থান জার্মান রাজনীতিতে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তাবাদী কট্টর রাজনীতি এখন আর নতুন কিছু নয়। ইউরোপের দেশে দেশে এই কট্টরবাদী রাজনীতির উত্থান ছড়িয়ে পড়েছে। হিটলারের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির অদলবদল ঘটিয়ে ইউরোপের নানা দেশেই তারা জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়েছে। নিজেদের সামাজিক সমস্যার কথা বলে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করছে, নিজেদের জাতিকে শ্রেষ্ঠ ও বীর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে এবং সর্বশেষ ইউরোপের বাইরে থেকে আসা অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ইসলাম বিদ্বেষ তৈরি করছে।
থুরিঙ্গিয়া রাজ্যে জার্মানির জন্য বিকল্প বা এএফডি দলটির সংসদীয় নেতা টোরবেন ব্রাগা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পাবলিক ল নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি দলটির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। তিনি জানান, তারা রাজনৈতিক মঞ্চায়নের জন্য নানা কৌশল ও ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে পারদর্শী।
আজ থেকে ৩৪ বছর আগে সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনঃ একত্রীকরণ ঘটে। সেই অঞ্চলে অনেক উন্নয়ন ঘটলেও সেখানকার পাঁচটি রাজ্যের জনগণ এখনো নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত বলে মনে করেন। এই অঞ্চলগুলোর অনেক ভোটার, বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলগুলোর জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতির সঙ্গে সমন্বয় বোধ করেন না।
বর্তমানে জার্মানির ক্ষমতাসীন জোট সরকারে অন্তর্ভুক্ত সামাজিক গণতন্ত্র, পরিবেশবাদী সবুজ দল ও লিবারেল গণতান্ত্রিক—এই তিন দলের মধ্যে নানা বিষয়ে তিক্ততা, বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং অভিবাসী ও শরণার্থীদের নিয়ে রাজনীতি পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় জার্মানির জন্য বিকল্প দলটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০২১ সালে অনুষ্ঠিত জার্মান সংসদের নির্বাচনে জার্মান পার্লামেন্টে বা বুন্দেশটাগে কট্টরবাদী জার্মানির জন্য বিকল্প দলটি আসন পায় ৭৭টি। জার্মানির ১৬ রাজ্যের ১১টি প্রাদেশিক পার্লামেন্টে দলটির সাংসদ সদস্যরা রয়েছেন।
ইউরোপের দেশে দেশে বর্ণবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হত্যা–হামলা ক্রমেই বাড়ছে, তবে জার্মানির বিষয়টি ভিন্ন। যারা দুটি বিশ্বযুদ্ধ করে পরাস্ত হয়েছে, তাদের সেই অপরাধবোধ বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার সেই দায়বদ্ধতা কোথায়!
জার্মানির বর্তমান জোট সরকারও জার্মান জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অভিবাসী বিষয়ে মূলধারার দলগুলোর দোদুল্যমান রাজনীতি জার্মানিতে নাৎসিদের নতুন করে উত্থানে সহায়ক হচ্ছে। এখন কট্টরবাদীরা জার্মানির মাটিতে যা ঘটাচ্ছে, তা রুখতে জার্মানির রাজনীতিতে নতুন ভাবনার সময় এসেছে।