জামায়াতের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
Share on:
শুরুতে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোয় জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে নির্মোহ বিশ্লেষণ পাওয়া কঠিন। অনেকে যেমন দলটিকে দানব আখ্যা দেয়, তেমনই কেউ কেউ দেবতা মনে করে।
বিশ্লেষকদের জন্যও দলটিকে নিয়ে বিশ্লেষণ কঠিন এর কাঠামোগত কারণেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনা ও কৌশল সম্পর্কে বাইরের লোকজনের স্বল্পবিস্তর জানা সম্ভব হলেও ‘ক্যাডারভিত্তিক’ জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটি প্রায় অসম্ভব।
দলীয় নির্দেশনার প্রতি নেতাকর্মীর নিঃশর্ত আনুগত্যই কেবল নয়; কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বের স্তরগুলোর কর্মপরিকল্পনার মধ্যে দুর্ভেদ্য দেয়ালের কারণেও এক স্তরের খবর অপর স্তরও জানতে পারে না। দলীয় ফোরামের বাইরের বিশ্লেষকরা হনুজ দূরস্ত!
এই প্রেক্ষাপটেও, গত বছর নভেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে এক নিবন্ধে লিখেছিলাম–“আমার ধারণা, দলটি এখনই কোনো পথে যাওয়ার বদলে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ‘মার্ক টাইম’ করছে। সামরিক প্রশিক্ষণে এর অর্থ হচ্ছে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মার্চ করতে থাকা। জামায়াতে ইসলামী সম্ভবত উপযুক্ত পরিবেশের জন্য অপেক্ষায় সেটাই করছে”। (চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে জামায়াতের ‘মার্ক টাইম’/ সমকাল, ৪ নভেম্বর ২০২৩)।
বাস্তবেও কমবেশি সেটিই ঘটেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই জামায়াতে ইসলামী দক্ষ তীরন্দাজের মতো আওয়ামী লীগের পতনকেই মাছের চোখ সাব্যস্ত করেছে। ওই নির্বাচনের আগে তৎকালীন সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও বিবিধ গোয়েন্দা বাহিনী যদিও জামায়াত প্রশ্নে স্পষ্টতই ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট’ নীতি গ্রহণ করেছিল, দলটিকে লক্ষ্য থেকে সরানো যায়নি। এমনকি তৎকালীন ২০ দলীয় জোটের প্রধান বিএনপির সঙ্গে জোটভিত্তিক বা যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যেও জামায়াত থেকেছে নিজের পথেই।
সেসময় অপর একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম- “প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী কি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির হিসাবমতো চলবে? এ ধরনের ক্যাডারভিত্তিক দল পরের মুখে ঝাল খাচ্ছে–এমন নজির বিশ্বজুড়েই নেই। সাময়িক কৌশলগত কারণে জোট বা আন্দোলনের ঐক্য হতে পারে; কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে নিজেদের নীতি ও কর্মসূচিই অনুসরণ করে থাকে। জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে অতীতে অনেকবারই সেটা দেখা গেছে”। (আওয়ামী লীগের গাজর এবং জামায়াতের দাঁত/ সমকাল, ১২ জুন ২০২৩)।
যাহোক, জামায়াতে ইসলামীর ‘মার্ক টাইম’ প্রবণতা আমার চোখে ধরা পড়ার পর গত ৯ মাসে মরা বুড়িগঙ্গা দিয়েও অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ঘটেছে। মাস দেড়েক আগেও আদালতের খাঁচায় খাঁচায় হাজিরা দেওয়া অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী গত ১ আগস্ট তৃতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হয়ে ২৭ আগস্ট সেই নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তও হয়েছে। এখন দলটি সম্ভবত নেতাকর্মীকে ‘ফরওয়ার্ড মার্চ’ তথা অগ্রসর হওয়ার আদেশ দিয়ে দিয়েছে।
এই ‘ফরওয়ার্ড মার্চ’ প্রবণতাকালে জামায়াতে ইসলামী যে দীর্ঘ আড়াই দশকের শরিক বিএনপিকেও আর পাত্তা দিতে চাইছে না, সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তায় তা স্পষ্ট। এমনকি যে গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বিএনপি ও জামায়াত যুগপৎ নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিল, সেই সরকারের মেয়াদ নিয়েও দল দুটির মধ্যে দ্বিমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যেমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় নিয়ে বিএনপির তাগাদা বিষয়ে নাম না করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক আলোচনা সভায় বলেন– ‘রাজনীতি তো জনগণের জন্য, তাদের তো উচিত এই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই সময়টায় ওখানে না দাঁড়িয়ে যদি নির্বাচন, নির্বাচন, নির্বাচন জিকির করলে জাতি তা কবুল করবে?’ আবার এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিবও নাম না করে বলেন–‘যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে। ... আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এতদিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করে এসেছি।’ (বিডিনিউজ, ২৮ আগস্ট ২০২৪)।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই অগ্রসরমান পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ আসলে কী? আমরা জানি, আশির দশক থেকে গত ৪০ বছরে ভোটের বাজারে যে চারদলীয় সমীকরণ তৈরি হয়েছিল, সেখানে ভোটের হিসাবে জামায়াতে ইসলামী চার নম্বরে থেকেছে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যখন পালাক্রমে এক নম্বর আসন ধরে রেখেছে; জাতীয় পার্টি তখন ধারাবাহিকভাবেই তিন নম্বর এবং জামায়াতে ইসলাম চার নম্বর আসনে ছিল।
অপরদিকে, ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে বিভিন্ন মামলায় জামায়াতের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের বেশির ভাগকেই হয় কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। গঠনতন্ত্র জটিলতায় ২০১৩ সালের আগস্টে হাইকোর্টের রায়ে এবং ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে আপিল খারিজ হলে নিবন্ধনও হারায় জামায়াত। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ ছয়জন শীর্ষ নেতার ফাঁসি হয়। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের নির্বাচনেও অংশ নেয়নি বা নিতে পারেনি।
দলের নিবন্ধন বাতিল, শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন, সব স্তরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা বা কারাদণ্ড, বড় অংশের নেতাকর্মীর আত্মগোপন বা ছদ্ম-নিষ্ক্রিয়তা, দলীয় কার্যালয় বন্ধ বা বেদখল, দলীয় ভাবাদর্শাধীন আর্থিক ও সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারানো সত্ত্বেও এখন স্পষ্ট যে, জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে বসে ছিল না।
পরবর্তীকালে কী পরিস্থিতি হবে জানি না; সাংগঠনিক ভিত্তি ও সমর্থক সংখ্যা বিবেচনা করলে অবধারিতভাবেই জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে জাতীয় পার্টিকে পিছে ফেলে তিন নম্বর স্থান দখল করেছে। আওয়ামী লীগ যদি সাংগঠনিকভাবে ফিরে আসতে না পারে, তাহলে সরল অঙ্কেই ভোটের বাজারে জামায়াতের আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও বিএনপির তাগাদার বিপরীতে একদা শরিক দলটি নির্বাচন প্রশ্নে দৃশ্যত দেরি করতে চাইছে কেন?
প্রথমত, গত দেড় দশকে জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় থাকলেও সামাজিকভাবে প্রকাশ্য হতে পারেনি। আর ভোটের বাজারে শুধু সাংগঠনিক তৎপরতা দিয়ে চলে না, সামাজিক তৎপরতাও গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন ও আহতদের পাশে দাঁড়ানো কিংবা বন্যায় ত্রাণ কর্মসূচি তারই অংশ। নির্বাচন যত দেরি হবে, দলটি যত বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারবে; ভোটের বাজারেও তত সুবিধা হবে।
দ্বিতীয়ত, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং জোট সরকারের অংশ হিসেবে ক্ষমতায় থাককালে জঙ্গিবাদ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতের যে ভাবমূর্তি সংকট দেখা দিয়েছিল, সেটাও কাটাতে চাইছে। এ কারণেই এবার গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন মন্দিরে পাহারা, পরিদর্শন এবং উগ্রবাদের বদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করায় জোর দিয়েছে দলটি।
তৃতীয়ত, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যখন নেতৃত্বহীন, মনোবলহীন, দিশাহীন; তখন সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিএনপির সমর্থনই ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী সম্ভবত এতটা প্রবল সংখ্যাগরীষ্ঠ বিএনপি চায় না, যেখানে ‘ছোট’ বিরোধী দল হয়ে থাকতে হবে। আবার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ‘ভ্যানগার্ড’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে কানাঘুষা রয়েছে। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্যও জামায়াতে ইসলামী আরও অপেক্ষা করতে চাইতে পারে। জামায়াত নিশ্চয়ই জানে, বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য পক্ষের ভোট যত ভাগাভাগি হবে, নিজেদের আসন সংখ্যা তত বাড়বে।