মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১৪, সেপ্টেম্বর ২০২৪

জনপ্রশাসনে ‘বড় ধরনের’ সংস্কারের এখনই সময়

Share on:

কর্মসূত্রে গত ২৪ বছরে আমাকে দেশের ৪৭টি জেলার পাঁচ শতাধিক ইউনিয়নে যেতে হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আমার কাজের ক্ষেত্র হলেও আমাকে এর সুবাদে উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের দেশের উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে কর্মকর্তা নিয়োগে একটি বড় ধরনের সংস্কার হওয়া দরকার।


উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলার শীর্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি। সাধারণত সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগদানের তিন বছর পর একজন ব্যক্তি নিয়মানুযায়ী সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। এর আগে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর উপজেলায় যদি তাঁর নিয়োগ হয়, সে ক্ষেত্রে তিনি সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজে যোগ দেন। বিসিএস উত্তীর্ণ প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তিন বছর চাকরি করার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান। অন্যদিকে একজন ডাক্তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ১০ থেকে ১৫ বছর পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। ফলে একই উপজেলায় কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধানের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এক ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। একই ঘটনা ঘটে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ অনেকের সঙ্গে।

প্রশাসনিক কাজ মানুষের সঙ্গে করতে হয় বলে আমাদের অবশ্যই সমাজের পরিবর্তন এবং সেই সমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়। আবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা বা উপজেলার শিক্ষা, শিক্ষিত সমাজ, স্থানীয় সরকারে কালক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। উপজেলার বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদেও উচ্চশিক্ষিত তরুণ ও প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদে আরও বেশি অভিজ্ঞ ও দক্ষ সরকারি আমলার নিয়োগ অত্যাবশ্যক। অথচ এ বিষয়ে নজর না দেওয়ায় বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ে এক ধরনের নড়বড়ে ও বিশৃঙ্খল সমাজ কাঠামো এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থা অনেক বছর ধরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে ২০১৪ সালের একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর। আমরা লক্ষ্য করি, সরকারের একতরফা নির্বাচনে ‘বিশেষ ভূমিকা’ পালনের সুবাদে প্রথমে উপজেলা প্রশাসন, পরে পুলিশ প্রশাসন ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী হিসেবে নিজেদের বলয় তৈরি ও দাপট দেখাতে শুরু করে। ফলে প্রশাসন জনগণের সেবক হওয়ার পরিবর্তে ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের মতো শাসক হয়ে ওঠে। এতে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকাণ্ড ও জনজীবনে এর প্রভাব আরও নেতিবাচক হয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রশাসনে ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে। ইতোমধ্যে অনেক পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রায় ৫০০ উপজেলা, ৬৪টি জেলা এবং আটটি বিভাগীয় শহরে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন সরকারের হাতে রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগের এটিই সেরা সময়। এক ধাপ করে এগিয়ে আনলেই মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে কাজের গতিশীলতা আনার পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাডারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পেশাজীবী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তার মানসিক দূরত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন একজন উপসচিব, যার অন্তত আট বছর সরকারি পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশে এখন সব উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক উপসচিব রয়েছেন। তবে এ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাদের ইতোপূর্বে অন্তত সহকারী কমিশনার (ভূমি) কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া ভালো। শুধু তাই নয়, প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেওয়া মাত্র সহকারী কমিশনার হিসেবে উপজেলাতে পাঠানোর পরিবর্তে সিনিয়র সহকারী সচিবদের উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে পাঠানো দরকার। এভাবে উপজেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিটি প্রশাসনিক পদে প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন জেলায় ডিসি পদে ন্যূনতম যুগ্ম সচিবদের নিয়োগ দিতে হবে। আবার যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ ও ক্যান্টনমেন্ট আছে এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর, সেসব জেলায় অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। কারণ আমাদের সরকারের পদমর্যাদাক্রমের যে তালিকা বা ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স, তার সঙ্গে যতটা সম্ভব মিলিয়ে পদায়ন করা হলে প্রশাসনিক কাজ সহজতর হবে। বিভাগীয় কমিশনার পদে সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া জরুরি। কারণ বাংলাদেশের কোনো বিভাগের গুরুত্বই রাজধানী ঢাকার থেকে কম নয়। এবং বিভাগীয় কমিশনার পদটিতে যখন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার পদায়ন হবে তখন প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কাজটি আরও সহজতর হবে।

আমরা কয়েক দশক ধরেই প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা শুনছি। কিন্তু এটা যতখানি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। একটা সময় ছিল যখন আমাদের সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা কম ছিল। সে সময়ে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। এখন সময় বদলেছে। জনপ্রশাসন সংস্কারে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়।

দৈনিক সমকাল