জনপ্রশাসনে পদোন্নতি-পদায়ন নিয়ে তুলকালাম!
Share on:
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা টেলিভিশনের ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শিরোনামে সাড়া জাগানো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কথা অনেকের স্মরণ থাকার কথা।
সেখানে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, তার দাগী আসামি ভাই, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল তারেক সিদ্দিক প্রমুখের গুম, খুন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার উঠে এসেছিল। বলা হয়েছিল, তারা সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লোক হিসেবে হেন অপকর্ম নেই, যা করেননি।
ওই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি ফটোকার্ড ফেসবুকে দেখা গেছে; লেখা ছিল– “আই অ্যাম শেখ হাসিনা’স মেন”। অনেক কার্ডে ইংরেজির সঙ্গে বাংলাও ছিল– ‘আমি শেখ হাসিনার লোক’। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করার আগে বিভিন্ন উপলক্ষে শেখ হাসিনাকে সাহস জোগাতে এ ধরনের ফটোকার্ড পোস্ট করতেন তাঁর অনুসারীরা। দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও কতিপয় দলবাজ, ধান্ধাবাজ সরকারি কর্মকর্তাও এ ধরনের ফটোকার্ড পোস্ট করে জানান দিতেন– তিনি পাবলিক সার্ভেন্ট নন; ব্যক্তিবিশেষের সার্ভেন্ট।
ক্ষমতার পালাবদলের পর তাদের অনেকের রূপ বদলেছে। যারা গর্বের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জানান দিয়েছিলেন, সেগুলোও মুছে দিয়েছেন। তবে কারও কারও স্ক্রিনশট অন্য কারও কাছে রয়ে গেছে। সেগুলো প্রকাশও হচ্ছে।
গত সোম ও মঙ্গলবার দেশের ৫৯টি জেলায় ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সুবিধাভোগী এবং নানা অপকর্মের জন্য কুখ্যাতি পেয়েছিলেন। কেউ কেউ ‘শেখ হাসিনার লোক’ হিসেবে ফটোকার্ডও পোস্ট করেছিলেন। এতে ১৫ বছর ধরে পদ ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সচিবালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল করেন। ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নতুন পদায়ন পাওয়া বেশির ভাগই হাসিনা সরকারের ফিটলিস্টের কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগী।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। ডিসি হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যাশা ছিল। কারণ তারা চাকরিজীবনে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তারা জানতে চান, কেন মেধা, যোগ্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে তালিকা করা হলো না? কীভাবে গত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা ডিসি পদে পদায়ন পেলেন? সর্বশেষ, বুধবার সমকাল অনলাইনের খবর অনুযায়ী, নবনিযুক্ত ৫৯ ডিসির মধ্যে ৮ ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর বৈষম্য-বঞ্চনার প্রতিকারে গত ৮ আগস্ট থেকে ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। যারা ক্ষোভ-বিক্ষোভ করছেন, তাদের স্মরণ রাখা দরকার, এরই মধ্যে তারা আংশিক হলেও প্রতিকার পেয়েছেন; মূল্যায়িত হতে শুরু করেছেন। একসঙ্গে সব বঞ্চনার অবসান ঘটানোর মতো ম্যাজিক কার্ড সরকারের হাতে থাকে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, এর পর যুগ্ম সচিব ও সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগেও তারা ছিলেন সিনিয়র সহকারী সচিব। চাকরির বাকি সময়ে পদোন্নতি হবে না– এমনটা নিশ্চিত জেনে অবসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ বা চাপ সৃষ্টিতে কতটা সুবিচার করছেন, তাও বিবেচনা করা দরকার।
পদোন্নতি, পদায়ন নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ে ভিন্ন মতাদর্শের বা প্রতিপক্ষ দলের শাসনকালে নিয়োগপ্রাপ্তরা বঞ্চিত হন। তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘ সময় ডাম্পিং করে রাখা হয়। কিন্তু প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে গত কয়েক দিনে সংঘটিত এসব ঘটনা উদ্বেগের। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায়ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা আসেনি। প্রশাসনিক কাজে গতিও শ্লথ হয়ে আছে। মাঠ প্রশাসনেও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
১৫ বছরে ব্যাপক দলীয়করণ, মেধা উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় পদোন্নতি, পদায়ন গোটা সিভিল প্রশাসনকে ভঙ্গুর ও নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। গত কয়েক দিনে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা দাবিতে বিক্ষোভ, আন্দোলন করছেন। দাবি আদায়ের মওকা হিসেবে এ সময়কে বেছে নিয়েছেন অনেকে। এতে ওইসব দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে মাত্র এক মাসের মধ্যে ১৫ বছরের দলীয়করণ ও বঞ্চনার প্রতিকার করা যে দুরূহ কাজ, তা কেউ বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।
অধিকার আদায়ে হইচই-হট্টগোল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাথরুমে আটকে রাখা কিংবা গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে ধস্তাধস্তিও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি। এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ তো ১৫ বছরে করার সাহস পাননি তারা। যারা জেলা প্রশাসক হতে চাইছেন; একটি জেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বর্তাবে তাদের ওপর। ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ে যে পন্থা বেছে নিচ্ছেন, তা প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা বা জনশৃঙ্খলার দায়িত্ব প্রত্যাশীর জন্য কতটা শোভন?
একই সঙ্গে পদোন্নতি-পদায়নের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের প্রতি আনুকূল্যের যে অভিযোগ আসছে, তা ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হতে পারে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে বর্তমান সরকারের যে অঙ্গীকার, তার সঙ্গে যায় না। ‘শেখ হাসিনার লোক’ সম্পর্কে কোনো ধরনের আনুকূল্য, পদায়ন-পুনর্বাসন অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।