জনগণের ভয় কি ভেঙে গেছে!
Share on:
মানুষ ভূতকে ভয় পায়। কারণ, ভূতকে সে দেখেনি। সে শুনেছে, ভূত বলে বিরাট মারাত্মক কিছু একটা আছে। ভূত বলে সত্যিই যদি কিছু থাকত আর তারা যদি দিনদুপুরে বিটকেলে চেহারা নিয়ে হাটবাজারে হাঁটাচলা করে বেড়াত; সবার সামনে দু-চারটে লোকের ঘাড় মটকাত, তাহলে আর লোকের মনে অতটা ভয় থাকত না।
ভয় কেটে যেত। লোকে তখন নিজেদের ঘাড় বাঁচানোর জন্য এক হয়ে ভূতের ঘাড় মটকানোর কায়দা খুঁজে বের করত।
পিস্তল-বন্দুক আর ক্ষমতা হলো ভূতের মতো জিনিস। এগুলো আড়ালে রাখতে হয়। পাবলিককে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে হয়, ‘সাবধান! পিস্তল কিন্তু আছে!’
অমুক লোক অনেক ক্ষমতাধর এবং তার কোমরে সব সময় পিস্তল থাকে, এটি যদি সাধারণ লোক জানে বা অনুমান করতে পারে, তাহলে তারা সেই লোককে ভয় পায়। যদি দেখে, সেই লোক কোমরে লুকানো পিস্তল বের করে না; অযথা হম্বিতম্বি করে ক্ষমতা জাহির করে না; তাহলে তাদের কাছে তার পিস্তল আর ক্ষমতা একটা ভীতিকর রহস্য হয়ে থাকে।
ক্ষমতা আর পিস্তলের অহেতুক ব্যবহার না থাকলে ভয়ের সঙ্গে সমীহ, এমনকি শ্রদ্ধাও যোগ হতে পারে।
কিন্তু পিস্তল যদি বাড়াবাড়ি রকমের ক্ষমতার ফুটানিতে ফটাফট গুলি ফুটাতে থাকে, তাহলে আর পাবলিকের ভয় থাকে না। গুলিতে মানুষ মরলে প্রথমে জনতা আকস্মিক আতঙ্কে ভ্যাবাচ্যাকা খায় বটে, কিন্তু খুব শিগগিরই সেই আতঙ্ক কেটে যায়। ভয় চলে যায়। ভয়ের জায়গায় ক্ষোভ আর প্রতিবাদ-প্রতিশোধের স্পৃহা জুড়ে বসে।
ছাত্রদের আন্দোলনে সেই জিনিস দেখা গেল। পুলিশের কোমরের পিস্তল-বন্দুক শুধু হাতে উঠে এল না, সেই পিস্তল-বন্দুক থেকে নির্বিচারে গুলি বের হলো।
নিজের ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ানো নারী থেকে শুরু করে বাবার কোলে থাকা বাচ্চাকেও সেই গুলি গিলে খেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো ভিডিও ফুটেজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেভাবে গুলি করতে দেখা গেছে, যেভাবে দুই হাত প্রসারিত করা আবু সাঈদকে গুলি করতে দেখা গেছে; যেভাবে কিশোর ও যুবা বয়সীর চোখ ছররা গুলিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায় এসেছে, তা নির্বিকার দলান্ধ ছাড়া দেশের সব স্তরের সব মানুষকে হকচকিত, বিস্মিত ও আতঙ্কিত করেছে।
হাসপাতালগুলোতে একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা লোক (যাঁদের বেশির ভাগই তরুণ যুবা) দেখে চিকিৎসকেরা পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
কিন্তু সেই ভীতি কর্পূরের মতো উবে গেছে। গতকাল শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। বহু আন্দোলনকর্মী গুলিতে আহত হয়েছেন। নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
কয়েক দিন আগে ইন্টারনেটের ‘নিজ থেকে চলে যাওয়ার’ কারণে সারা দেশ যখন তথ্যের আলো না পেয়ে অন্ধকারে ডুবে ছিল; টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে যখন ‘ভূরুঙ্গামারীতে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন’মার্কা নিউজ ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ (যদিও ‘সংঘর্ষ’ শব্দটি এখানে হয়তো খাটছে না; কারণ দুটি সমান শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার করা উচিত) হচ্ছিল।
আন্দোলনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ সবই হলো। মানুষের ক্ষোভ দমাতে প্রাণঘাতী বুলেট ও অন্যান্য মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে তাঁদের ওপর গুলি ছোড়ার যে দৃশ্য আমরা দেখলাম, তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সারা দেশ যেন ভয় পেয়ে গেল। সবাই যেন অবিশ্বাস্য আতঙ্কে দুকদম পিছিয়ে গেল।
কিন্তু পরে দেখলাম, কোত্থেকে যেন আবার সবাই সাহসী হয়ে উঠলেন।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব, শহীদ মিনার, শাহবাগ এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ দেখতে গিয়ে খেয়াল করছিলাম, তাঁদের মধ্যে কোনো ভীতি বা আতঙ্ক কাজ করছে কি না। তাঁদের চোখে যেন সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলার সাহস দেখেছি। ‘এত সাহস যে আর ভয় করে না।...না ভয় করে না। ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা’ লাগল।
মাসখানেক আগেও প্রকাশ্য রাজপথে যেসব স্লোগান দেওয়া সাধারণ মানুষের কল্পনার অতীত ছিল, সেসব স্লোগান এখন সুতীব্র ও উচ্চকিত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। যে পুলিশ-বিডিআর মাত্র কয়েক দিন আগেই আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, গতকাল যুদ্ধের সাজে থাকা সেই বাহিনীর সদস্যদের সামনে তাঁদের অকুতোভয় অবস্থায় দেখলাম।
মনে হলো যেন তাঁরা একযোগে বলছেন, ‘আমাকে হত্যা করলে বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব; আমার বিনাশ নেই। বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব। আমার বিনাশ নেই।’
এখন রাস্তায় যে আন্দোলনকারীদের দেখবেন, তাঁদের চোখেমুখে আপনি দুঃখ, বেদনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ—সব পাবেন। কিন্তু ভয় পাবেন না। কারণ, পিস্তল পকেট থেকে হাতে উঠে এসেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা এই আন্দোলনের আগেও সরকারের হাজার অন্যায্য কাজকে ‘স্নেহের চোখে’ দেখতেন। ‘সাত খুন মাফ’ করার সুরে ‘ধুর, বাদ দেন’ বলে হাজার অন্যায় উড়িয়ে দিতেন। সেই তাঁদেরই অনেককে এখন আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করতে দেখছি।
বন্দুকের মারণক্ষমতা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মনে যে ভীতিজাগানিয়া রহস্যময়তার পর্দা ছিল, গুলি ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পর্দা ছিন্ন হয়ে গেছে। এতগুলো গুলিবিদ্ধ লাশ দেখে পাবলিকের মনের সেই ভয়ের আস্তরণ খসে পড়েছে।
এটি এখন পরিষ্কার, মানুষের মধ্যে এখন আর আগের মতো পুলিশভীতি নেই। ছাত্রলীগ বা যুবলীগকে, বিশেষত আন্দোলনকারীরা এখন আর ভয় করেন না।
গত কয়েক বছরে আমরা যেভাবে হেলমেটধারীদের লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে দেখেছি, এখন সেটি খুব কঠিন হবে বলে ধারণা করি। কারণ, সাধারণ মানুষের ভয় ভেঙে গেছে।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগকে কখনো এতটা জনবিচ্ছিন্ন দল মনে হয়নি।
গতকাল ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক তাঁর নিজের এলাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী তাঁর মাধ্যমে নানা সময়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন চুপ রয়েছেন। এমনকি অনেকে তাঁর ফোনও ধরছেন না; অর্থাৎ মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা গা বাঁচিয়ে চলা শুরু করেছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে।
রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে এখন যাঁরা বিক্ষোভ করছেন, তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখ করার মতো অংশ মাসখানেক আগেও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা এই আন্দোলনের আগেও সরকারের হাজার অন্যায্য কাজকে ‘স্নেহের চোখে’ দেখতেন। ‘সাত খুন মাফ’ করার সুরে ‘ধুর, বাদ দেন’ বলে হাজার অন্যায় উড়িয়ে দিতেন।
সেই তাঁদেরই অনেককে এখন আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করতে দেখছি।
একসময় যাঁরা বিএনপি ও জামায়াতকে সহ্য করতে পারতেন না, তাঁদের কাউকে কাউকে এখন সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে দেখছি।
এই পটভূমি এক দিনে তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে সরকারের প্রতিটি স্তরে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। সেই সিন্ডিকেটের মধ্যে সুস্থ রাজনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল লোকদের যতটা না ঠাঁই দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে টাকার জোরে পদবি কেনা লোকদের। ফলে দুর্নীতি তলা থেকে মাথা পর্যন্ত ছেয়ে গেছে।
সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর দুর্নীতিবাজদের জুলুম সহ্য করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছে। যাঁরা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক, তাঁরা মুখে হয়তো সরকারের সব কাজ সমর্থন করছেন, কিন্তু মনে তাঁদের অভিমানের পাহাড় জমা হয়েছে।
রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, শনির আখড়াসহ যেসব জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে, সেসব জায়গায় ছাত্রদের সঙ্গে লুঙ্গি পরা কিংবা শ্রমজীবী মানুষকে যোগ দিতে দেখা গেছে।
অনেকে বলছেন, এঁরা কারা? এঁরা তো ছাত্র নন! এঁরা এখানে কেন?
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, এসব লোক হলেন এমন সব শ্রমজীবী মানুষ, যাঁরা পুলিশকে এবং পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে আসা শ্রমিক লীগ, যুবলীগকে শত্রুর চোখে দেখেন। লেগুনা চালিয়ে খায়, এমন এক কিশোর বলল, ট্রাফিক পুলিশ তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার লোকজন আসেন। তাঁদেরও টাকা দিতে হয়। দিনের পর দিন টাকা দিয়ে যেতে হয়।
মহল্লায় রাস্তার পাশে যে লোকটা সবজি বেচে সংসার চালান, তাঁকে নিয়মিত সরকারি দলের লোকদের একবার এবং পুলিশকে একবার চাঁদা দিতে হয়।
পুলিশের ওপর সবচেয়ে বিরক্ত মনে হয়েছে, রিকশাওয়ালাদের। নানা সময়ে ট্রাফিক পুলিশের হাতে নিগৃহীত হওয়ায় তাঁদের মনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ।
এর মধ্যে কোটি কোটি ডলার পাচারের ঘটনাকে যখন সরকারের দিক থেকে পাত্তা দেওয়া হয় না; যখন শত শত কোটি টাকা মেরে দেওয়া কর্মকর্তাদের নিরাপদে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে সুযোগ করে দেওয়া হয়, তখন সবার মধ্যে নাগরিক হিসেবে অমর্যাদার অনুভূতি হয়।
এই অমর্যাদার অনুভূতি মূলত এসব লোককে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়েছে।
আর রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের সেখানে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁরা এই আন্দোলন থেকে তাঁদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইবেনই।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হওয়া মানুষদের দেখে মনে হয়েছে, সেখানে সব মতের, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতি ছিল। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র, আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—সব শ্রেণির মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এসব মানুষের একটি বিরাট অংশ কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত এই সরকারের সমর্থক ছিল।
কিন্তু সবকিছুর ওপরে, দলমতের ওপরে প্রত্যেক ব্যক্তি যেহেতু দিন শেষে একজন মানুষ; যেহেতু তাঁর সাধারণ মৌলিক মানবিক বোধ আছে; সেহেতু আওয়ামী লীগের বহু সমর্থকসহ অধিকাংশ নাগরিক বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে দুই শতাধিক মানুষ হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ। ক্রুদ্ধ। বিচারপ্রার্থী এবং অবশ্যই ভয়হীন।