মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ২, সেপ্টেম্বর ২০২৪

জনগণের অমীমাংসিত চাহিদা পূরণে বিএনপি কত টুকু প্রস্তুত?

Share on:

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি একাধিকবার বলেছেন, জনগণের ‘চাহিদা পূরণ’ করতে অতি দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন। বাস্তবে এ মুহূর্তে নির্বাচনের দাবি বিএনপির চাহিদা হতেই পারে; জনগণের চাহিদা কী?


বরং গত ১৫ বছরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত রাষ্ট্র পুনর্গঠন জনগণের চাহিদা হতে পারে; নির্বাচন নয়। অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু তার আগে অমীমাংসিত ব্যাপারগুলোর সুরাহা হতে হবে। তার বদলে নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপাচাপি ভুল রাজনীতি।

বস্তুত গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অস্থিরতা স্পষ্ট। দলটি একবার বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তারা সময় দিতে প্রস্তুত। আবার বলছে, দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা বিএনপি নেতৃত্বের কথায় ফুটে ওঠে না– বিষয়টি দুঃখজনক বটে।

এই মুহূর্তে নির্বাচনের দাবি খোদ বিএনপির রাজনীতির জন্যই ক্ষতিকর। ভোটে তারা জিতে এলেও একটা দলীয় সরকারের পক্ষে বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে রাতারাতি হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপির বরং উচিত অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কী ধরনের রাজনীতি তারা করবে, তা জনগণের সামনে খোলাসা করা।

গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল কীভাবে দেশজুড়ে অরাজকতা ও লুটতরাজ থামানো এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা যাবে। বিএনপি সে ব্যাপারে আলোচনা করেছে কিনা, অন্তত পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পারিনি।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা বর্তমানে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, এর সারাংশে দুটো দিক পাওয়া যায়। এক. প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। দুই. ব্যক্তির পক্ষে সংস্কার করা সম্ভব নয়; জনগণ সংস্কার করবে। জনগণ বলতে তারা বোঝাতে চাইছেন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত বিএনপি সরকার। অর্থাৎ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি সংস্কার করলে সেটাই ‘জনগণের সংস্কার’ বলে ধরে নিতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি কী সংস্কার করবে? কীভাবে করবে? এ ব্যাপারে বিএনপি কি কোনো রূপরেখা দিয়েছে? ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের আগে বিএনপি ‘রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা’ পেশ করেছিল। সেখানে সংস্কার, মেরামতের প্রসঙ্গ থাকলেও এর আগে আমরা দেখিয়েছি, ওই ২৭ দফা ছিল মূলত বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে কিছু কমিশন গঠনের ওয়াদা মাত্র (দেখুন: মারণ-রাজনীতির ভূমিকা, সারোয়ার তুষার ও সহুল আহমদ)

দেশে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে বিএনপির বক্তব্য কী? তারা কি বিদ্যমান সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখেই এর অধীনে নির্বাচনে যেতে চায়? নাকি নতুন ও পরিবর্তিত গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায়? এ প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান খোলাসা করা জরুরি।

বিএনপি মহাসচিব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সংস্কারের রূপরেখা চেয়েছেন। তাঁর এই দাবি প্রশংসনীয়। তিনি এ দাবিই আরও স্পষ্ট করে তুলতে পারতেন– অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী ধরনের সংস্কার কীভাবে করবে তা জনগণ জানতে চায়। সেটা কাজের হতো। এটাও মনে রাখতে হবে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের বয়স এখনও এক মাস হয়নি; তার মধ্যেই ভয়াবহ বন্যাকবলিত দেশের বেশ কয়েকটি জেলা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সংস্কারের রূপরেখা আমরাও চাই। কিন্তু এক মাসের কম বয়সী সরকারের কাছে নির্বাচন চাই না। অবশ্যই নির্বাচন হবে। তার আগে কোন ধরনের সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হবে, সেই ফয়সালা করতে হবে। এই মুহূর্তে বিএনপিকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের বাইরে এসে জনগণের স্বার্থকে ধারণ করতে পারতে হবে। বিদ্যমান সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে এর অধীনে ক্ষমতায় যেতে চাওয়া গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক।

ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামোর কতখানি পরিবর্তন করবে বা আদৌ করবে কিনা– সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দলটি দিচ্ছে না। ‘নির্বাচিত’ সরকারের নামে অপরিবর্তিত ক্ষমতা কাঠামোর মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনা জনগণের বীরোচিত অর্জন ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন সাধনে বিএনপি কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে– জাতির সামনে আগে বরং সেই রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।

দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে এই মুহূর্তে গণঐক্য আর গণক্ষমতা গঠনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বিএনপির থাকা দরকার। দলীয় নয়; এখন গণশক্তির রাজনীতি করার সময়। গণশক্তি পরিগঠনে বিএনপির পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকা উচিত। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণক্ষমতার আবির্ভাব ঘটেছে, সেই ক্ষমতা পরিচর্যা করা, টিকিয়ে রাখা এবং রাষ্ট্র গঠন পর্যন্ত জনগণ হয়ে জনগণকে মাঠে রাখার ব্যাপারে দলীয় কর্মীদের কোনো নির্দেশনা কি দিয়েছে বিএনপি?

ওদিকে মাঠ থেকে বিএনপি নেতাকর্মীর নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে আসছে। জনগণের অর্জনকে কুক্ষিগত করতে না চেয়ে রক্ষা করাই হবে এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য। গণক্ষমতাকে ঘরে পাঠিয়ে দলীয় ক্ষমতা কায়েম করতে মরিয়া মনোভাবকে জনগণ অভ্যুত্থান আত্মসাতের চেষ্টা হিসেবেই বিবেচনা করবে।

স্বীকার্য, গত ১৫ বছর বিএনপি নেতাকর্মী অনেক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির রাজনীতি সফল হয়নি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের মাধ্যমে নয়; ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে দেশের ইতিহাসের তীব্রতম গণঅভ্যুত্থানে। এ বাস্তবতা বিএনপিকে মেনে নিতে হবে এবং ভুল থেকে শিখতে হবে।

১৫ বছর আওয়ামী লীগ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে বিএনপি। অথচ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠছে বিএনপির নামে। এই কাজ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা এবং বিএনপির জন্য আত্মঘাতী।

ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের লক্ষ্যে এবারের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। কোনো জনগণের পক্ষের শক্তি ফ্যাসিস্ট সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইতে পারে না।

নির্বাচন লাগবে না– এমন দাবি কেউ করবে না। কিন্তু বিএনপি যেভাবে নির্বাচনের প্রশ্ন বারবার সামনে আনছে, তা অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণচেতনার সঙ্গে খাপ খায় না। দেশের ভয়াবহতম দুর্যোগের বাস্তবতার সঙ্গেও বেমানান।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংসদ নির্বাচন দিতেই হবে। তার আগে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট একব্যক্তিতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে সংসদ নির্বাচন, নাকি পরিবর্তিত গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে নির্বাচন– এই প্রাথমিক প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি।