জিডি করিনি, পোস্টমর্টেম করাইনি, শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি
Share on:
পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে একজনকে টেনে নিচে ফেলা হলো। তিনি সাঁজোয়া যানের চাকার কাছে সড়কে পড়ে থাকেন। এরপর পুলিশের এক সদস্য সাঁজোয়া যান থেকে নিচে নামেন।
এক হাত ধরে তাঁকে টেনে আরেকটু দূরে সড়কে ফেলে রাখেন।
এখানেই শেষ নয়, পরে কয়েকজন পুলিশ মিলে তাঁকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে ঠেলে অপর পাশে ফেলে দেন।
এ দৃশ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের দৃশ্য নয়। এই নারকীয় চিত্র স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে গুলি করে এভাবে রেখে যায়।
ফেসবুকে দৃশ্যটি ভাইরাল হওয়ায় আমার চোখেও পড়ে এবং দেখার পর এটি ভুলতে পারছি না কিছুতেই। প্রথম আলোর প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন ও শামসুজ্জামান ইয়ামিনের এই নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন।
এটা করতে গিয়ে ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘ সময় কথা বলেন। মো. মহিউদ্দিনকে একজন স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষ বলেই মনে হলো। তিনি বলছেন, ‘একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারও কাছে বিচার চাই না। জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি।’ কারও বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভের প্রকাশ বা নালিশ না করলেও একটা চাপা অভিমান ঠিকই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথার মধ্যে।
কোটাবিরোধী তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আওয়ামী লীগসহ অনেকেই স্বাধীনতা–বিরোধীদের আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করছে। সত্য হলো, এটা নিছকই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। তবে জামায়াত-শিবিরের লোকজনও এখানে থাকতে পারেন, সেটি অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। সেটিকেই প্রাধান্য দিয়ে কিছুদিন আগেই হাসিনা সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তারপরও হাসিনার পদত্যাগ–পরবর্তী আলোচনায় সেনাপ্রধান জামায়াতের আমিরকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অথচ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস মন্তব্য করেছেন, ‘জামায়াত এ মুহূর্তে নিষিদ্ধ একটা দল।’
জনগণের স্পন্দন বুঝতে পারার অক্ষমতা, গ্রাউন্ড রিয়েলিটি তথা মাঠপর্যায়ের সত্যকে অস্বীকার করার কারণেই হাসিনা সরকারের পতন হলো। পতন-পরবর্তী সময়েও যদি আওয়ামী লীগ আন্দোলনের ভুল পাঠ করে, দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সে জন্যই আন্দোলনের চারিত্র্য এবং গতি-প্রকৃতির সঠিক বিশ্লেষণ জরুরি।
শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের নির্মম হত্যাকাণ্ড কিছু বিষয় পরিষ্কার করেছে। ইয়ামিনের বাবার ভাষ্যে এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়েছে; যেমন তিনি বলেন, ‘তাঁর ছেলে পুলিশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর তাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। আমার ছেলেকে কেউ রাজনৈতিক দলের দাবার ঘুঁটি বানাক, তা আমরা চাই না। আমার ছেলে রাজনীতি–সচেতন ছিল। আমিও রাজনীতি–সচেতন। তবে কোনো দল করি না। ছেলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়েছে, তার কোনোটিতেই রাজনীতি করার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা ধার্মিক পরিবার। ছেলে নামাজ পড়ত। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ছিল। এটা দেখে কেউ যদি আমার ছেলেকে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির বা জামায়াত বানানোর চেষ্টা করে, তা তো আমরা হতে দেব না।’
এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল অর্থনীতিবিদ ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজনেস স্কুলের ডিন ড. মেহেরুন আহমেদের কথায়, যিনি নিজেও ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আন্দোলনটা সংগঠিত হয়েছে সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা, যাঁরা বিরাজমান কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত নয়। ছাত্রশিবির এটাকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগিয়ে এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কেউ যদি আন্দোলনে শামিল হয় কারও কিছু থাকে না।’
ড. মেহেরুনের মুক্তিযোদ্ধা বাবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর কাজী সালেহ আহমেদ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাম ধারার রাজনীতি করেছেন, তিনি নিজেও সাম্যের দর্শনে বিশ্বাস করেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ হতে পারে একমাত্র পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বর্তমান আন্দোলন ও দেশের রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক গতিধারা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টেনে আনেন ড. মেহেরুন। বলেন, ‘সংস্কৃতি ও ধর্ম আলাদা জিনিস। দুটোকে মেলাতে চেষ্টা করলেই বিপত্তি ঘটে। ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিমপ্রধান দেশ এবং তাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও সনাতন ধর্মের গ্রন্থ, রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র যেমন রাম, হনুমান ইত্যাদি তাদের ইতিহাস, পাঠ্যপুস্তক, দেয়ালচিত্র—সর্বত্র জীবনের অংশ হয়ে আছে। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসন এখানে সংস্কৃতিকে পরিহার করতে শেখায়নি। আমাদের দেশেও এমনটা হওয়া দরকার। কারও বাইরের পোশাক দেখেই জামায়াত-শিবির ব্র্যান্ড দিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায়।’
ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায় ইয়ামিনকে কবর দেওয়া হয়েছে। তাঁর কবরে একটি তুলসীগাছ ও একটি ফুলের চারা লাগিয়েছেন মা নাসরিন সুলতানা। আবাসিক এলাকার ভেতরে থাকা শহীদ মিনারে ইয়ামিনের ছবি দিয়ে একটি ব্যানার টানানো হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাধারণ মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দিচ্ছেন। বোঝা যায়, পরিবারটি ধার্মিক হলেও কতটা উদার।
তুলসীগাছ সনাতন ধর্মের লোকেরা একটি পবিত্র গাছ হিসেবে গণ্য করেন। সাধারণত সনাতন বাড়িতেই এ গাছের দেখা মেলে বেশি। কিন্তু ইয়ামিনের মা ছেলের কবরে একটি তুলসীগাছ রোপণ করেছেন। তাই আজকের নিবন্ধের এ রকম একটা শিরোনাম দিতে মন চাইল। শ্রদ্ধা জানাতে মন চাইল মা ও ছেলে—দুজনকেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে অর্ধমৃত ইয়ামিনকে নির্দয় পুলিশ যেভাবে অবমাননা করল, সে দৃশ্য আক্ষরিক অর্থেই আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে, যা কবিতায় বিধৃত হয়েছে এভাবে:
এক ফোঁটা জল
গড়াতে গড়াতে
ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল,
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে
প্রধান ফটকের বাইরে
বালুর সমুদ্রে এসে মিলিয়ে গেল
কেউ দেখল না!
এই ভেজা মাটিতেই একদিন
জন্ম নেবে জীবনের বিষবৃক্ষ;
বহু দূর থেকে উড়ে উড়ে
তার ডালে এসে বসে থাকবে
বেদনার নীলকণ্ঠ
কেউ জানবে না!