মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৯, সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধের দাবি কি আবারো ঘোমটা পরবে?

Share on:

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি আবারও উঠেছে। দাবিটি এখন এতই জোরালো; ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার বলে পরিচিত খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচিরেই তা কার্যকর হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।


ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে; এমনকি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটও পালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বুধবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ নামে এক সংগঠনের অনলাইন জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতিকে ‘একেবারেই নিষিদ্ধ’ দেখতে চান। যে শিক্ষার্থীরা মাত্র ক’দিন আগে দোর্দণ্ড প্রতাপধারী শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করেছেন, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে, তাদের এমন মতকে উপেক্ষা করেন?

প্রতিবেদনমতে, ৩ থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিচালিত জরিপে ঢাবির ২ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। তারা সবাই ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী। অর্থাৎ তরতাজা তরুণ বলতে যা বোঝায় কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মূল শক্তি হিসেবে যে ‘জেন-জি’ পরিচিত, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা তাদেরই সাক্ষাৎ প্রতিনিধি।

প্রসঙ্গত, আশির দশকের মাঝামাঝি ক্ষমতাসীন সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আলাপ ওঠে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামরিক শাসনবিরোধী মত প্রবল থাকায় তা হালে পানি পায়নি। ১৯৯০ সালের যে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে, সেটার নেতৃত্বে ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্রনেতারা, যাদের পেছনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রায় একাট্টা ছিলেন।

তবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ ফিরে আসে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি ফিকে হওয়ার আগেই। পরিহাসজনক, এ আলাপের সূত্রপাত ঘটান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, যাঁকে গণঅভ্যুত্থানের রূপকার ছাত্রনেতারাই এরশাদের বিদায়ের পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে বসিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার দুই দশক পর ১৯৯১ সালে বহুল কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পথ করে দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সম্ভবত সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতেই ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগ তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তৎকালীন জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়েই সাহাবুদ্দীন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রস্তাব দেন। অবশ্য অন্য সব ছাত্র সংগঠনের মতো ছাত্রলীগও এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংসদে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যে এ প্রস্তাবে সায় দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে ওই দফায়ও অচিরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর হাতে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর সেখানকার শিক্ষার্থীদের চাপে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে প্রায় সবাই একান্তই বুয়েটের বিষয় বলে মনে করেছিলেন। তাই এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে কেউই তখন চিন্তিত হননি।

সম্ভবত একই প্রেক্ষাপটে গত ১৫ জুলাই রাতে যখন রোকেয়া হলসহ কিছু হলে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চাপে সব ছাত্র সংগঠনের তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তখন বিষয়টিকে স্রেফ ছাত্রলীগের ওপর ক্ষোভের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ মনে হয়েছিল। মনে আছে নিশ্চয়, ওই রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকার-সমর্থিত সংগঠনকে ঢাবি থেকে কার্যত উৎখাত করেছিলেন।

এমনকি আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা যখন সরকারের সঙ্গে আলোচনার শর্তরূপে ৯ দফার মধ্যে ‘লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধের দাবি করেন, তখনও মনে হয়নি অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে এতটা সিরিয়াস। কারণ তখন ইতোমধ্যে এ খবর চাউর হয়ে যায়, আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে আছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তিসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এমনকি ১৫ আগস্টের আগে আগে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ ৩৪টি ডান-বাম ছাত্র সংগঠন নিয়ে ওই ছাত্র শক্তির নেতাদের সভা থেকে দেওয়া বিবৃতিতেও সবাই শান্তিপূর্ণ তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্রলীগের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে কাজ করার অঙ্গীকার করেছিলেন।

ছাত্র শক্তির দুই নেতা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। অন্য নেতারাও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির বিভিন্ন পদে আছেন, যাকে পর্যবেক্ষকরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগের ধাপ হিসেবে বর্ণনা করছেন। তদুপরি তারা ইতোমধ্যে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ছাত্র শক্তির কার্যক্রম স্থগিত করার কথা জানিয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিবিরোধী অবস্থানের কারণেই কি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে বিকাশের প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ছাত্র শক্তির কার্যক্রম গুটানো হলো?

যা হোক, আলোচ্য জরিপের কিছু ফল আমার অদ্ভুত মনে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘শুধু ছাত্র সংসদ চান, তবে দলীয় ছাত্র রাজনীতি চান না’ বলে মতামত দিয়েছেন। উপরন্তু দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিকল্প হিসেবে প্রায় ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, প্রস্তাবিত ডাকসু নির্বাচনে কি এখনকার মতো প্যানেল থাকবে? প্যানেল মানেই তো সমমনাদের সমাবেশ, যা প্রকারান্তরে দলীয় রাজনীতিরই আরেক ধরন। এখনও যে ডাকসু নির্বাচন হয়, তাতে কিন্তু দলীয় পরিচয় থাকে না; দলের লোকেরা প্যানেলবদ্ধ হয়েই নির্বাচন করেন। তবে বর্তমানে নির্বাচনে দলীয় পরিচয় স্বীকৃত না হলেও সংশ্লিষ্ট প্যানেলের শিক্ষার্থীরা দলীয় পরিচয়েই সারাবছর ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকতে পারেন।

এ প্রশ্নও তোলা যায়, একটি প্যানেলের শিক্ষার্থীরা সমমনা হওয়া সত্ত্বেও সারাবছর যদি দলবদ্ধভাবে তৎপরতা চালাতে না পারেন, এর ফায়দা কার ঘরে যাবে? নিশ্চিতভাবে যাদের গোপনে দলীয় তৎপরতা চালানোর দক্ষতা আছে তখন তাদেরই পোয়াবারো হবে। এটাও বলা যায়, একটা গণতান্ত্রিক বা মুক্ত সমাজে শত ফুল ফুটতে দেওয়ার যে পরিবেশ থাকার কথা, সেটাও ক্ষুণ্ন হবে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা নিষিদ্ধ হলে। কে না জানে, একটা বদ্ধ জলাশয়ে পোকামাকড়ের ঘরবসতি যতটা গড়ে ওঠে, ততটা উন্মুক্ত জলাশয়ে সম্ভবপর হয় না।

নিঃসন্দেহে দলীয় রাজনীতির আড়ালে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ভয়ংকর ড্রাকুলায় পরিণত হয়। কিন্তু কে অস্বীকার করতে পারে, তার কারণ যতটা দলীয় পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের রাজনীতি করা, তার চেয়েও বেশি ক্যাম্পাসের ওপর নানা কারণে চরম অবক্ষয়ের শিকার জাতীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব? তাই মাথাব্যথার জন্য মাথা না কেটে বরং ক্যাম্পাসে শত ফুল ফোটার ব্যবস্থা করাই হতে পারে এ রোগের মহৌষধ।

পাকিস্তান আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিশেষত ঢাকা কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় ছাত্র রাজনীতি করা যেত না; তখন শিক্ষার্থীরা নানা ফুল-পাখির নামে প্যানেলবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ সেই ছাত্র রাজনীতিকে ঘোমটার আড়াল থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ দিয়েছিল। আবারও যদি ছাত্র রাজনীতিকে সেই ঘোমটা পরানো হয়, তা কতটুকু টেকসই হবে, ভেবে দেখা জরুরি।

দৈনিক সমকাল