ছাত্র-জনতার বিজয় সংহত রাখতে করণীয়
Share on:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শত শত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ ছিল। সমস্যার সূত্রপাত হয় যখন সরকারপক্ষীয় ছাত্র ও হেলমেট বাহিনী বিক্ষোভকারী ছাত্রসমাজকে মারধর ও হয়রানি করে।
এরই প্রতিবাদে সারাদেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ফুঁসে ওঠে এবং রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটের সামনে বীরের মতো বুক পেতে দেয়। এ ছাড়াও এ আন্দোলনে মুগ্ধসহ অনেক শিক্ষার্থী ও নিরীহ পথচারী শহীদ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয় আদালতের রায়কে সামনে রেখে। ছাত্র-জনতা তখনও সরকার পতনের চিন্তা করেনি। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন, কারফিউ জারি, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সারাদেশ থেকে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটকের মধ্য দিয়ে এক দফাকে অনিবার্য করে তোলে। সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে আটকে নির্যাতন এবং এক টেবিলে ভাত খেয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করায় উচ্চ আদালতও সেটাকে ‘জাতির সঙ্গে মশকরা’ বলে আখ্যা দেন। এর পর আর শেষরক্ষা হয়নি। বাকিটা ইতিহাস।
আন্দোলনের বিজয় এত দ্রুত এলো যে, পরবর্তী করণীয় নিয়ে ছাত্রদের হোমওয়ার্কের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না। সে জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অরাজক পরিস্থিতি দেখা দেয়। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে শাস্তি, চাঁদাবাজি, ঘরবাড়ি পোড়ানো হতে থাকে। ভালো-খারাপ নির্বিশেষে গণহারে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। এসব কারণে গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ম্লান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের গুন্ডাদের সঙ্গে পার্থক্য ঝাপসা হয়ে আসছে। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে কিছু পরামর্শ দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব মনে করি।
গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তাদের পরিবারের একজনকে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরি দিন এবং এককালীন কিছু অর্থ সাহায্য করুন। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করুন। হতাহতদের পরিস্থিতি ছাত্র প্রতিনিধিদের সাহায্যে যাচাই করুন; পুলিশ বা কোনো বাহিনীর মাধ্যমে নয়।
সব সরকারি অফিস, বিশেষত ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার, থানা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার অফিসগুলোতে ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ঘুষ, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করুন। এ কমিটি যেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিন।
সব নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করুন। কোটা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দলীয় আনুগত্য ইত্যাদি পরিহার করুন। শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও ছাত্রাবাস নির্মাণ, প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে টিনশেডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অন্যান্য সরকারি অফিসের রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করুন। দলীয় বিবেচনা না করে বরেণ্য শিক্ষাবিদদের ভিসি নিয়োগ দিন। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশ থেকে ভিসি নিয়োগ দিন। ছাত্রদের মাধ্যমে শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করুন। শিক্ষকদের বেতন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্ধারণ করুন; প্রমোশনের ক্ষেত্রে গবেষণার সংখ্যা ও মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার করুন।
আমলাতান্ত্রিক নির্ভরশীলতা কমানো জরুরি। এ দেশে অতীতে কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করা সচিবকে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তা করার রেকর্ড আছে। তাই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার থেকেই ওই দপ্তরের প্রধান নিযুক্ত করুন। যেমন স্বাস্থ্য ক্যাডারের প্রধান প্রশাসক স্বাস্থ্য ক্যাডারের সিনিয়র যোগ্য ব্যক্তি হবেন। প্রশাসন ক্যাডারকে ভূমি রাজস্ব আদায় ও সরকারের কাজে নিয়োগ করুন। বাজার ব্যবস্থার সংস্কার করুন। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কঠোর হাতে দমন করুন।
দেশি-বিদেশি শত্রুদের উস্কানি ও গুজবে কান দেবেন না। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, তবে সব সময় সজাগ ও জাগ্রত থাকবেন।
পরিশেষে, গণমানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুন। কারও প্রতি জুলুম, অন্যায়, নির্যাতন করবেন না। কেউ অপরাধী হলে তাকে আইনে সোপর্দ করুন। মনে রাখবেন, ‘তুমি অধম– তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’ সব স্তরে সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন এবং ড. ইউনূসের কথামতো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান ইত্যাদি বাছ-বিচার না করে সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিন্তা করুন। দেখবেন, বাংলাদেশ অতি অল্প সময়ে বিশ্বের রোল মডেল হবে।