মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৯, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জয় যেন ‘বেদখল‘ না হয়

Share on:

একসময় ঢাকার থিয়েটার পাড়ায় নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো ‘‌গডোর প্রতীক্ষায়’ নাটকটি নিয়মিত মঞ্চস্থ হতো। নাটকের প্রেক্ষাপট পরাবাস্তব একটি সমাজের চিত্র, যেখানে চরিত্রগুলো চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। তারা বিশ্বাস করে, গডো নামীয় এক ত্রাতা আসবে তাদের সব দুঃখ, যন্ত্রণ, অভাব ইত্যাকার সবকিছু থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুত পরিত্রাণকারী গডো কখনো আসে না।


কিন্তু আমাদের এ জনপদের মানুষ যখন প্রায় ১৬ বছর দেশে থেকেও দেশহীন, মানবাধিকারহীন স্বৈরাচারের নির্মম অত্যাচারে নিজেকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি ভেবে চরম হতাশাগ্রস্ত, ‘‌গডোর প্রতীক্ষায়’ নাটকের প্রেক্ষাপটের মতো তখনই আমাদের মুক্তির মহানায়ক হয়ে আসে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার এক দুর্দমনীয় ঢেউ। যে ঢেউয়ে স্বৈরাচারের ভয়ংকর সব বাহিনী, ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ভেসে যায় নিমেষে।

ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছাত্রদের সম্মিলিত স্রোত ঐতিহাসিক আবাবিল পাখির সঙ্গে তুলনীয়, যাদের সৃষ্টিকর্তা সম্রাট আবরাহার বিরাট হস্তী বাহিনীর বিরুব্ধে পাঠিয়েছিলেন পবিত্র কাবাঘর রক্ষার জন্য। দিব্য চোখে দেখতে চাইলে মিরাকল শুধু অতীতে নয় এখনো ঘটছে। এ দেশের শাসক যখন সেবাদাসী আর মন্ত্রীরা ভৃত্যের মতো প্রতিবেশী দেশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীপ্রধানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীরা যখন সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্মতিতে নিয়োগ পায়, তখন এ দেশের নাগরিকদের আর নিজেকে স্বাধীন ভাবার কোনো অবকাশ থাকে না। গ্লানিময় মিথ্যা স্বাধীনতা, হতাশাগ্রস্ত মানুষ যখন ভাবছে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেয়া হয়তো আর জীবৎকালে হবে না ঠিক তখনই আমাদের জাতীয় জীবনে এ আগস্টের শুরুতে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল তারুণ্যের হাত ধরে। বিএনপি ক্রমাগত আন্দোলন করেও সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি, কিন্তু তরুণ ছাত্ররা সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে তিন সপ্তাহের আন্দোলনে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটা জাগদ্দল স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। অনেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কী অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটে গেছে।

এ ছাত্ররাই দেশের ক্রান্তিলগ্নে বারবার ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে এসেছে ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৯০-এর আন্দোলনে। ‘তারুণ্যেই শক্তি, তারুণ্যেই মুক্তি’—আবারো একই ভূমিকায় ছাত্ররা। চূড়ান্তভাবে এ বিজয়ের রূপকার দেশব্যাপী সংগঠিত ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। ফেসবুকে ডুবে থাকা এ প্রজন্ম দিয়ে যে কিছু হবে না এমনটাই প্রত্যয় হয়েছিল সবার। কিন্তু এ আপাত শান্ত জেন-জি প্রজন্ম যে আমাদের মুক্তির নিয়ামক হবে তা ছিল আমাদের কল্পনার অতীত। দেশবাসী ভুলতে বসেছিল ছাত্রদের মাঝে নিহিত অমিয় শক্তির কথা। কোটা সংস্কারের এক দফা দাবি থেকে নয় দফা, চূড়ান্তভাবে সরকার পতনের এক দফায় রূপান্তর হলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন সরকারের চরম দমননীতির ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।

ঝড়ের গতিতে চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশবাসী স্বৈরশাসনমুক্ত হয়েছে। এখন ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের কাছে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশার একটা রূপরেখা উপস্থাপনের জন্য বিপ্লবোত্তর ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আশু করণীয় নির্ধারণ করা।

সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতা নিয়ে ধাতস্থ হতে যেমন আমাদের সময় লেগেছে তেমনি যে বিরাট অর্জন এ ছাত্ররা আমাদের উপহারস্বরূপ তুলে দিল, সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত করা যাবে না। আমরা ১৯৭১ ও ১৯৯০-তে ঘুরে দাঁড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছি। এবার হাতে পাওয়া দেশ সংস্কারের স্বপ্ন যদি আমরা হেলায় হারাই তবে অনাগত প্রজন্ম আমাদের ব্যর্থতার জন্য কখনো ক্ষমা করবে না। প্রশাসনিক শূন্যতার ডামাডোলে আর বিজয়ের অতি উচ্ছ্বাসে এরই মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি সংঘটিত হয়ে গেছে। এখনই সময় আত্মসমালোচনা আর আত্মশুদ্ধির পদক্ষেপ নেয়ার, যাতে এ বিপ্লবের ফসল আমাদের এবং আমাদের অনাগত প্রজন্মের জন্য মূল্যবান সম্পদ হিসেবে সুরক্ষিত থাকে।

এ কথা ভাবার অবকাশ নেই যে শুধু তিন সপ্তাহের একটি বিপ্লব দেড় দশকব্যাপী গড়ে ওঠা স্বৈরাচারের ভিত্তিকে উপড়ে ফেলতে পেরেছে। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীনতা, ভোটাধিকার হরণ, ব্যাপক দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিরূপ মনোভাবের জন্ম দেয়। আন্দোলনের জন্য পরিপক্ব সেই মাঠ এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলন তাই স্বল্প সময়ে সফলতার মুখ দেখে। সার্থকতার বীজ প্রোথিত ছিল ছাত্রদেরই হাতে রচিত ২০১৮-তে গড়ে ওঠা দুটি সফল আন্দোলন। প্রথমত, নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা ২০১৮ সালের সফল আন্দোলন থেকে রাষ্ট্র মেরামত এবং সংস্কারের একটা বাস্তবিক উদাহরণ ছাত্ররা সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয়ত, সেই বছরই ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিলোপ করতে সরকার বাধ্য হয়। নেতৃত্বহীন বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি সময়ে সময়ে আন্দোলনের সূচনা করলেও গণসম্পৃক্ততা তৈরি করতে না পারা এবং দুর্বল সাংগঠনিক ক্ষমতার ফলে তাদের আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিংস্র ও দমনমূলক পদক্ষেপের কারণে তারা বারবার পিছু হটে। এমনকি শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতার এবং অন্তরীণ করার মাধ্যমে কার্যত আন্দোলন সংগঠিত করার উপায় রহিত করা হয়।

বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলন আর হেফাজতের আন্দোলনের পটভূমি থেকে ছাত্র আন্দোলনের পরিচালনা পদ্ধতি ছিল ব্যতিক্রমী। প্রথমত, ছাত্রদের এ আন্দোলন কোনো একক নেতৃত্ব বা কেন্দ্রীয় চরিত্রনির্ভর ছিল না, দেশব্যাপী সমন্বয়ক, সহসমন্বয়কদের মাধ্যমে একাধিক স্তরে সংগঠিত ছিল। একক নেতৃত্বের চেয়ে যৌথ নেতৃত্বের কাঠামো যে অনেক বেশি মজবুত ও ফলপ্রসূ তা বলাই বাহুল্য। প্রথম কাতারের নেতাদের সরকার আটক করে জেলজুলুম আর নির্যাতন করলেও পরবর্তী স্তর সেই নেতৃত্বশূন্যতা পূরণ করে আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলেছে। নির্দ্বিধায় গুলির মুখে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে, কিন্তু পিছু হটেনি। আন্দোলন সংগঠন আর পরিচালনার এ পন্থা মোটাদাগে বিজয় অর্জনের মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম সারির নেতৃত্ব আটক হলেও পরবর্তী সারির নেতৃত্ব ঠিকই আন্দোলন আরো বেগবান করে এগিয়ে নিয়েছে। মৃত্যুভয়হীন দৃঢ়চিত্ত জনতা সহজেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা পেরিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে।

বিপ্লব করা সহজ কিন্তু সরকার চালানো সহজ নয়, এমন ধারণা নিয়ে সবাই যখন সমালোচনায় মুখর, তখনই ছাত্ররা আমাদের সেই ধারণা বারবার ভুল প্রমাণ করে দেখিয়েছে। তারা আমাদের জন্য এনে দিয়েছে এক অধরা মুক্তির স্বাদ, তেমনি বিপ্লবোত্তর সময়ে যখন প্রশাসনবিহীন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীশূন্য, বিশৃঙ্খলা সময়ে বারবার প্রমাণ করেছে, তারা ভেঙে পড়া এ দেশটাকে বিনির্মাণ আর মেরামত করার জন্য দক্ষ হাত। চরম অরাজক ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তাদের সাফল্য অভিনব। পরাজিত শক্তির দোসররা যখন কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী, রাতের বেলা সারা দেশে সংঘবদ্ধ ডাকাতির নাটক তৈরি করে জনমনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল, কুমিল্লা, ফেনী অঞ্চলের বন্যায় আক্রান্ত লাখ লাখ মানুষ তখনই এ ছাত্রশক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাড়ামহল্লায় বাসিন্দাদের সংগঠিত করে সেই চক্রান্তও ধূলিসাৎ করে দেয়া এবং ত্রাণ কার্যক্রমে আবার প্রমাণ করল তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও সুসংগঠিত।

বিচার বিভাগীয় ক্যুর প্রচেষ্টা এবং সাম্প্রতিক আনসার সদস্যরা যে অন্যায্য পথে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছিল সেটাও তারা সম্মিলিতভাবে রুখে দিয়েছে। সমন্বয়ক নাহিদ ও আসিফকে যখন উপদেষ্টা করা হলো তখন চিরায়ত সংশয়বাদীরা সমালোচনা মুখর হয়ে উঠল। ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান করা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত একটা সিদ্ধান্ত। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রত্যেক উপদেষ্টা নিয়োগ হয়েছে অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ, সৎ এবং কোনো দলীয় আনুগত্যবিহীন দেশপ্রেমিক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। তবে অধিকাংশ উপদেষ্টার সত্তরোর্ধ্ব বয়স একটা বিবেচ্য বিষয়, কেননা বয়স আর কর্মস্পৃহার সঙ্গে একটা স্বাভাবিক যোগসূত্র বিদ্যমান, যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এটা বিশ্বাস করা যুক্তিসংগত যে দেশে ৩০-৫০ বছর বয়সী এমন অনেকেই আছেন যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতার সঙ্গে অবদান রাখতে পারে। তারা তাদের জীবনী শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে এ ক্রান্তিকালে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

সরকার পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী ছাত্রদের আরো কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তার পদ্ধতি ও উপায় আমাদের ভাবতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে বিভিন্ন নির্বাহী এমনকি সিনেটরদের অফিসে বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের ইন্টার্ন হিসেবে কাজের সুযোগ দেয়া হয়, যা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাথমিক পাঠ হাতে-কলমে শিখে এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় অবদান রেখে একটি সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যুগ বদলের এ ছাত্রশক্তি থেকেই আমাদের রাষ্ট্র পরিচালক তৈরি করতে হবে। এ আন্দোলনের পুরোভাগে আমরা অনেক অকুতোভয় ছাত্রীদের অবদান দেখতে পাই। যারা অবলীলায় পুলিশের গুলি আর সাঁজোয়াযানের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলনের দুঃসাহসী বাঘিনীরা: উমামা ফাতিমা, নুসরাত তাবাসসুম, ফারজানা সিনথিয়া, নাজিফা, নাহিদা বুশরা ফাতিহা, মাইশা এমনই শতনাম যেন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়।

নব্বইয়ের সফল ছাত্র আন্দোলনের পটভূমিতে সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। দেশকে ক্রমান্বয়ে এক ব্যক্তি, এক দলনির্ভর নিষ্ঠুর স্বৈরাচারের লীলাভূমি হতে দেখেছি। আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকায় ঘটে যাওয়া সফল আন্দোলন পরে দ্রুত সময়ে পতিত স্বৈরাচার রাজাপাকসে পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। তেমনি শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন পুনর্বাসিত হয়ে ছাত্র-জনতার বিজয়কে দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত না করে, সেজন্য আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।

ডিসেম্বর ১৯৮৯ ঘটে যাওয়া রোমানীয় বিপ্লবে নিকোলাই চশেস্কুর পতন আর আমাদের বিপ্লবে স্বৈরাচারী হাসিনার পলায়ন অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। আমাদের বিপ্লবকে মজবুত ও সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে সেই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের ঐতিহাসিক পাঠ নেয়া প্রয়োজন। সুদীর্ঘ ৪২ বছরের সমাজতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে নিষ্ঠুর শাসক চশেস্কু ক্ষমতায় ছিলেন ২৮ বছর। তার সিকিউরিটাট নামীয় গোপনীয় পুলিশ বাহিনীর অবস্থান ছিল সর্বত্র। তাদের ভয়াবহ নির্যাতনে কোনোরূপ বিরোধী মত মাথাচাড়া দেয়ার অবকাশ ছিল না। জনরোষের বারুদের পাহাড় জমে ছিল দীর্ঘদিন। টিমুসারা শহরে ক্ষুদ্র একটি বিদ্রোহ দমনের জন্য চশেস্কু তার অতন্ত ঘনিষ্ঠ জেনারেল ভিক্টর স্ট্যানকুলেস্কুকে দায়িত্ব দেন। বিদ্রোহকালে বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই আন্দোলন দাবানলের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রোমানীয় আন্দোলনের পুরোভাগ ছিল ছাত্র, শ্রমিক, জনতার মিলিত শক্তি।

সেই আন্দোলনেও নেতৃত্বের তিনজন ছাত্রকে আটক করা হয়, যেমন আমাদের আন্দোলনের ছয়জনকে হারুনের ভাতের হোটেলে আপ্যায়ন করা হয়। কিন্তু জেনারেল ভিক্টর আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেয়। যেমনটি হাসিনা নিকটাত্মীয় সেনাপ্রধান নিয়োগ দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। নিরুপায় চশেস্কু হেলিকপ্টারে স্ত্রীসহ প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান এবং একটি কৃষি খামারে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তাকে সপরিবারে আটক করা হয় এবং ২৫ ডিসেম্বর তারই ঘনিষ্ঠ জেনারেল ভিক্টরের গঠিত সামরিক আদালতে ড্রামহেড ট্রায়াল নামক সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সেদিনই প্রাসাদের উন্মুক্ত চত্বরে শত জনতার সামনে ফায়ারিং স্কোয়াডে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ে চশেস্কুর এককালের সহযোগী ইয়ান ইলিয়েস্কু ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট (এফএনএস) নামে নতুন পার্টি গঠন করেন।

বিদ্রোহের পাঁচ মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এফএনএস নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। বিরাট এক রাজনৈতিক শূন্যতায় কমিউনিস্ট পার্টি ও গোপন পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বস্থানীয়রাই আবার তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় ফিরে আসে। তবে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা আবার নতুন নামে ক্ষমতায় ফিরে আসুক তা অব্যশই আমাদের কাম্য নয়। তাই সময়ে সাধু সাবধান আপ্তবাক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। রোমানিয়ান বিপ্লবের বিষয়ে অধ্যাপক দিলেতান্তের সুন্দর একটা পর্যবেক্ষণে বলেছেন, রোমানিয়ান বিপ্লব আমাদের কাছে একটা বিষয় প্রতিভাত করে, ‘বীরেরা জীবন উৎসর্গ করে, যোদ্ধারা ঘরে ফিরে যায় আর সুযোগসন্ধানীরা সেই ফাঁকে লুটপাটে শামিল হয়।’ আমাদের বিপ্লবের ভাগ্যে যেন তেমনটা না ঘটে, বিশেষ করে ছাত্রশক্তিকে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সবে বিজয়ের প্রভাতকালে। রাষ্ট্র মেরামতের কাজ সবে শুরু হলো। তাই বিপ্লবের কাণ্ডারি আর যোদ্ধাদের ঘরে ফেরার সময় অনেক দূরে। তাদের অনুপস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ আর বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণে নতুন স্বাধীনতা আবারো সংকটে পতিত হবে। সুযোগসন্ধানীরা আবার দেশকে লুটপাটের আস্তানা করে তুলবে।

লেখক: গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) মফিজুর রহমান

দৈনিক বণিক বার্তা/a>