সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ২৬, সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ ইতিহাসের দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করুন

Share on:

জাতি হিসেবে আমাদের পুরনো ইতিহাস স্মরণে রাখার মানসিকতা কম। আমরা সারাদিনই ইস্যুর সাগরে ডুবে থাকি। তাই গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যু চলমান ইস্যুর চাপে হারিয়ে যায়। অন্যদিকে, রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা বা সামাজিক অনেক কার্যক্রমে আমরা বেশিরভাগই খুব হালকা ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকি।


জনপ্রিয়তা, সাময়িক ফায়দা এগুলোই আমাদের কাজেকর্মে বেশি অগ্রাধিকার পায়। তাই মৌলিক কাজগুলো সেভাবে করা হয় না। যারা নীতি নির্ধারক তারাও অধিকাংশ সময় গতানুগতিক কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকায় মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা বস্তুনিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারেন না।

এটি সাম্প্রতিক কোনো সংকট নয়। বাংলাদেশ গঠনের পর থেকেই আমরা এই সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে যারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বা ইসলামী মূল্যবোধ লালন করেন, তাদের মধ্যে বয়ান তৈরি করা বা ইতিহাস রচনা করার সক্ষমতা বিপরীত মহলের তুলনায় অনেকটাই কম। বিগত সাড়ে ১৫ বছর এই দেশ একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সিংহভাগ ফ্যাসিস্ট শাসনের নিপীড়নে অতিষ্ঠ ছিল। কিন্তু এগুলোর মোকাবেলায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া হলেও এগুলো নিয়ে গবেষণা, ইতিহাস রচনা, আর্কাইভ তৈরি করা কিংবা ফ্যাসিবাদ বিরোধী বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা ছিল- যার সুবিধা ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী বারবারই পেয়েছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর সারাদিনই ফেসুবকে তরুণ প্রজন্ম দুই মাসের আগের এই দিনটি স্মরণ করেছে। কীভাবে সেই রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সবগুলো হল থেকে এবং একইসাথে দেশের অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয় থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলা হয়েছিল তাও স্মরণ করেছে। শ্লোগানের বিকৃতি বা ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার কথাও তখন সামনে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ ইস্যুতে রীতিমতো ঝড় উঠেছিল।

এই আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে আবারও যে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে তা হলো, এবারের অভ্যুত্থান নিয়েও ইতিহাস রচনার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ভিকটিমদের চিকিৎসা, তাদের পুনর্বাসন এবং ভিকটিম পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকায় ইতিহাস রচনার কাজে এখনো মনোনিবেশ করা যায়নি। যে কাজগুলো ভিকটিমদের নিয়ে করা হচ্ছে তা অত্যন্ত জরুরি এবং এগুলো অব্যহত রাখতেই হবে। একইসাথে, ইতিহাস ও গবেষণার কাজটিও শুরু করতে হবে।

অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট কী ছিল, ঠিক কোন চেতনাগুলোকে সামনে রেখে এই আন্দোলনের সূচনা হয়, কোন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছিল এগুলো যেন মানুষের মন ও মগজ থেকে হারিয়ে না যায়। আন্দোলনের শহীদদের তালিকা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তবে তালিকা করাই যথেষ্ট নয়। যারা জীবন দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই একটি গল্প আছে। ঘটনা আছে। তাদের পিতামাতার সাথে শেষ বিদায়ের স্মৃতি আছে। এগুলো উপজীব্য করে গল্প, উপন্যাস ও ইতিহাসের বই রচিত হওয়া প্রয়োজন।

এগুলো করার দায় শুধুমাত্র সাহিত্যিকদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। কেননা, এগুলো গবেষণাধর্মী কাজ। অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একনিবিষ্ট হয়ে করার মতো কাজ। এর জন্য চাই আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশাসনিক সহায়তা এবং সার্বিক মূল্যায়নের আশ্বাস। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারনী অবস্থায় রয়েছেন তারা যদি এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন বা এই ধরনের কাজের গুরুত্ব না দেন, তাহলে চুড়ান্ত বিচারে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেননা, মানুষের স্মৃতিতে যদি অভ্যুত্থানের চেতনা না থাকে, তাহলে ইতিহাসের বিকৃতি অনিবার্যভাবেই ঘটবে। আর ইতিহাস যখন তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে, তখন সেখানে শূন্যতা তৈরি হয়। আর সেই শূন্যতা দিয়েই অপশাসন ও অপসংস্কৃতি ফেরার সুযোগও সৃষ্টি হয়।

আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে চলমান অন্যান্য সব কাজ করার পাশাপাশি এগুলোকে ইতিহাসের দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করার জন্যেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

দৈনিক সংগ্রাম