ছাত্ররাজনীতির নামে ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ নিষিদ্ধ হোক
Share on:
বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হয়েছে। ৫ আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ১২টায় শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে একটি হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন-সংগ্রাম সরকার উৎখাতের এক দফা ধ্বংসযজ্ঞে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই। শেখ হাসিনার অবিমৃষ্যকারী ও বালখিল্যসুলভ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য কোটা রাখবে না তো কি রাজাকারদের নাতি-পুতিদের জন্য কোটা রাখা হবে?’ কটূক্তির পরপরই ছাত্র-ছাত্রীরা স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার, দেশ বিকানো স্বৈরাচার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ এবং ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’ ছাত্র-ছাত্রীরা কতখানি ক্রোধান্বিত হলে নিজেদের ‘ঘৃণিত রাজাকার’ অভিহিত করতে দ্বিধা করে না সেটা শেখ হাসিনা কি আদৌ উপলব্ধি করতে পেরেছেন? মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার সব ছাত্র-ছাত্রীর ন্যায্য সাংবিধানিক অধিকার, যে অধিকার ২০১৮ সালে সদ্যবিদায়ী সরকার স্বীকার করে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্টের রায়ে সে অধিকার হারাতে বসেছিল তারা। তাই এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে তাদের চাওয়া ছিল ন্যায্য। সেটা চাইতে গিয়ে তাদেরকে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ গালাগাল শুনতে হবে কেন?
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুঃখজনক মন্তব্যটি আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল কোটাবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন। ওই পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করে রাজপথ থেকে বিতাড়নের জন্য ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওদেরকে হটাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। তার নির্দেশ পেয়ে লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু এর বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়ায়। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশের পর লাশ পড়তে শুরু করে। অন্যদিকে তুমুল গতিসঞ্চারিত হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে, যার পরিণামে ছাত্রলীগ মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার ক্ষমতাচ্যুতির বিপদটি ডেকে এনেছেন। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে অসম্ভব করে দেয়ার পরিণতি হয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাত অথবা দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হলো স্বৈরাচারী একনায়ককে হত্যা করা। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সশরীরে পালিয়ে যেতে পারলেও গত কুড়ি দিনের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে চার শতাধিকের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। শেখ হাসিনা কোনোমতেই এই প্রাণহানির দায় এড়াতে পারবেন না। জাতীয় সম্পদের যে অপূরণীয় ধ্বংসযজ্ঞ আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হলো সেটা আমাদের কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে তাও ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অর্থনীতি যে কতখানি পঙ্গু হয়ে গেল তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও দেশের অগ্রগতি যে একেবারেই থমকে গেল সেটা এখনই বলা চলে। এখন শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুর ওপর বিএনপি-জামায়াতের প্রতিশোধ গ্রহণের মহাযজ্ঞ, সেটা কতদিন ধরে চলবে বলা মুশকিল! আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে সশস্ত্র বাহিনী কিংবা পুলিশ বাহিনী এই প্রতিশোধ ক্যাম্পেইন থামানোর কোনো প্রয়াসই নেবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এখানেই আমার প্রশ্ন—জনাব ওবায়দুল কাদের যে ছাত্রলীগকে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর দুবার লেলিয়ে দিলেন তার মানে ছাত্রলীগ কি আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী? সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আন্দোলনকারীদের আইন অনুযায়ী মোকাবেলা করবে সেটাই তো নিয়ম। তাহলে এক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে ওবায়দুল কাদের কি ‘ক্রিমিনাল অপরাধ’ করেননি? ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রদলকে লেলিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রদলই যথেষ্ট’। তার ওই বক্তব্যের তিন মাসের মধ্যেই বেগম জিয়ার সরকারের পতন হয়েছিল। ছাত্রদল কি পতন ঠেকাতে পেরেছিল? ছাত্রদের পেটোয়া লাঠিয়াল বাহিনী বানিয়ে এ দেশের কোনো সরকারই গদি রক্ষা করতে পারেনি, সেটা ওবায়দুল কাদের কীভাবে ভুলে গেলেন?
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই অপসংস্কৃতিটা শুরু করেছিলেন আইয়ুব-মোনায়েমের স্বৈরাচার সরকার। ১৯৬৭ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম, হল বেছে নিয়েছিলাম জিন্নাহ হল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল আইয়ুব-মোনায়েমের মাস্তান বাহিনী এনএসএফের ত্রাসের রাজত্ব। গলায় সাপ পেঁচিয়ে এনএসএফের মাস্তান খোকার ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী এখনো আমাদের স্মরণে আছে। ঢাকা হলের আরেক মাস্তান পাসপাত্তুর কাহিনীও সবার মনে ভয় জাগাত। জিন্নাহ হলেও ছিল তাদেরই দাপট। এনএসএফের বেশ কয়েকজন মাসলম্যান জিন্নাহ হলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতির কারণে ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত হলের নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে ধরে নিয়ে এনএসএফের সভাপতি সাইফুল্লাহর কক্ষে জোর করে সহসাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনের প্রার্থিতা ফরমে স্বাক্ষর নেয়া হলো। ওখান থেকে ছাড়া পেয়েই আমি হলের একজন আবাসিক শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে প্রভোস্টের বাসায় গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলাম। বলাবাহুল্য, এনএসএফের নির্বাচনী মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করায় তখন থেকেই তাদের কোপদৃষ্টিতে পড়ে গিয়েছিলাম। ১৯৬৮ সালের জুলাইয়ে হলের মেসে এনএসএফের কয়েকজন মাস্তানের ডাবল কোপ খাওয়ার বিরুদ্ধে ‘স্পষ্টভাষী’ ছদ্মনামে আন্দোলন গড়ে তোলায় আমাকে এক রাতে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো এক মাস্তানের রুমে, মারধর করার জন্য। হলের ছাত্ররা খবর পেয়ে ওই রুমের কিছুটা দূরে জড়ো হলো। মাস্তানরা যখন অন্য ছাত্রদের দেখতে পেল তখন আমাকে শারীরিক নির্যাতন করল না। শুধু অকথ্য গালাগাল করে ছেড়ে দিল। এর মাসখানেকের মধ্যেই এনএসএফের সবচেয়ে বড় মাস্তান ‘পাসপাত্তু’ খুন হয়ে গেল, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। পাঁচ মাস পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলল তখন গণ-অভ্যুত্থানের টালমাটাল সংগ্রামের দিনগুলো শুরু হয়ে গেছে। জিন্নাহ হলেও ক্ষমতার পালাবদল হয়ে গেল আইয়ুব-মোনায়েমের পতনের পর।
১৯৭২ সালে মুজিববাদী ছাত্রলীগকেও পরিণত করা হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে, শুরু হয়ে গিয়েছিল বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন। ১৯৭৩ সালে ডাকসুর নির্বাচনে পরাজয় এড়ানোর জন্য তারাই ছিনতাই করেছিল ব্যালট বাক্সগুলো। আবার নিজেদের দলীয় কোন্দলের কারণে তারাই কোহিনূরসহ সাত ছাত্রকে খুন করেছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১-৮২ পর্যন্ত চলেছে জিয়াউর রহমানের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হওয়া ছাত্রদলের প্রচণ্ড তাণ্ডব। জিয়াউর রহমান ছাত্রদলের মাস্তানদের নিয়ে জাহাজে করে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কাহিনী এখন হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন! আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদ একই স্টাইলে ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে’ গড়ে তুলেছিলেন তার লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। কিন্তু ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের দুর্ধর্ষ মাস্তান হামিদের হাতের কব্জি কেটে নেয়ার মাধ্যমে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছিল জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ইসলামী ছাত্রশিবির। ফলে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাস্তানদের অলিখিত শাসন অব্যাহত ছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হলেও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের আঁতাতের কারণে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কোনো বিরোধে জড়ায়নি ছাত্রদল। তার পরও বিএনপির লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ছাত্রদল ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেজন্যই ১৯৯৫ সালে বেগম জিয়ার বিশ্বাস ছিল ছাত্রদল তার সরকারের পতন ঠেকাতে পারবে, যা তারা পারেনি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা কমাতে পারেনি, যেজন্য কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের লাশ পড়ত ওই বছরগুলোয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবার ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের তাণ্ডব পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশে। ২০০১-০৬ মেয়াদে ছাত্রলীগ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারেনি, ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত ছিল তারা। তাদের তাণ্ডব আবার শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, যা ১৫ বছর ‘আনচ্যালেঞ্জড’ থাকার পর এবারই পরাজিত হয়েছে।
ওপরে দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও শিবিরের ভূমিকা পালনের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমার প্রশ্ন, ছাত্রলীগ, শিবির ও ছাত্রদলকে ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল বাহিনী বানানোর এই অপসংস্কৃতি আর কতদিন চালানো হবে? স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল ভূমিকা কেন থাকবে? ছাত্র-ছাত্রীরা চাইলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দল করতে পারে, এটা তাদের অধিকার। কিন্তু, রাজনৈতিক দলের পেটোয়া লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক অপব্যবহারের শিকার হওয়া এবং বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে কোটিপতি হওয়ার এই অপসংস্কৃতি কখন বন্ধ হবে? আর শিবিরকে জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডার বানানোর বিপজ্জনক খেলা কখন বন্ধ হবে? এখনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতির নামে লাঠিয়াল পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।